ধনী ও দরিদ্র দেশে করোনার অভিঘাত ভিন্ন কেন
পিনেলোপি কোজিয়ানো গোল্ডবার্গ
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১১:২৯ | অনলাইন সংস্করণ
বিশ্বজুড়ে একটি বৃহত্তর ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে যে কভিড-১৯ মহামারী বিভিন্ন দেশের ভেতরে অসমতা বাড়িয়েছে। কিন্তু আন্তঃদেশগুলোর মধ্যে অসমতার প্রভাব কেমন, তা খুব কমই আলোচিত হয়েছে। মূলত উন্নত দেশগুলোয় নভেল করোনাভাইরাসের অসমানুপাতিক প্রভাবের কারণে শেষোক্ত বিষয়টি অনেকটা উপেক্ষিত থাকছে বৈকি।
প্রথম দিকে অনেকেই মনে করেছিল চলমান মহামারীতে ধনী দেশগুলোর চেয়ে দরিদ্র দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে অধিক পর্যুদস্ত হবে। ২০২০ সালের মে মাসে ইনিশিয়েটিভ অন গ্লোবাল মার্কেটস পরিচালিত এক জরিপে অর্থনীতিবিদদের প্যানেলের অধিকাংশই সম্মত হয়েছে ভাইরাস ও লকডাউনসৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি চূড়ান্তভাবে অসমানুপাতিক হারে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় বেশি পড়বে। অনুরূপভাবে, এপ্রিলে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা ইয়নইয়েভার সঙ্গে নীতিনির্ধারকরা একই মত পোষণ করেছিলেন। সংস্থাটির ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘স্বাস্থ্য সংকট যেভাবে নাজুক দরিদ্রদের বেশি আঘাত হানে, তেমনি অর্থনৈতিক সংকটও দুর্বল দেশগুলোকে বিপর্যস্ত করে।’
অনুমান করা হয়েছিল নিম্ন ও দরিদ্র দেশগুলো সরকারি স্বাস্থ্য সক্ষমতা ও আর্থিক সম্পদের ঘাটতিতে বেশি ভুগবে। কিন্তু তথ্য ভিন্ন গল্প বলে। ২০২০ সালের জুনে এক গবেষণা প্রবন্ধে বিশ্বব্যাংকের ট্রিসটান রিড এবং আমি দেখিয়েছি প্রতি মিলিয়ন মানুষের মধ্যে কভিডে মৃত্যু মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর তুলনায় উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় বেশি, এমনকি চীনকে হিসাবের বাইরে রাখলেও। আবার মহামারীর বাঁকবদলগুলো বিভিন্ন আয় স্তরে নানা দেশের মধ্যে লক্ষণীয়ভাবে ভিন্ন ছিল।
ডিসেম্বরের এক আপডেটে আমরা যেমনটা দেখেছি এই ধরন বজায় থেকেছে। নিঃসন্দেহে মাথাপিছু আয় ও প্রতি মিলিয়ন মৃত্যুর মধ্যে একটি শক্তিশালী ইতিবাচক আন্তঃসম্পর্ক রয়েছে। অনেকের কাছে এই ফলাফল একটি পরিমাপগত ভুল (মৃত্যুর সংখ্যা দরিদ্র দেশগুলোয় কম যথাযথভাবে নির্ণয় হওয়ার প্রেক্ষাপটে) হিসেবে বিবেচিত হলেও উভয় শ্রেণীর দেশের মধ্যে পার্থক্যের বিপুলতা এত বড় যে তা কোনোভাবে উপেক্ষার সুযোগ নেই।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মৃত্যু ১ হাজার ৩২৩ জন এবং যুক্তরাজ্যে ১ হাজার ৪৯৬ জন; অথচ দক্ষিণ আফ্রিকায় (আফ্রিকায় সবচেয়ে পর্যুদস্ত দেশ) ৭১২ জন, ভারতে ১১১ জন, ইন্দোনেশিয়ায় ১০৭ জন, অ্যাঙ্গোলায় ১৪ জন এবং নাইজেরিয়ায় ৭ জন মাত্র। এরই মধ্যে লাতিন আমেরিকার অনেক উচ্চমধ্যম আয়ের দেশেও ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই ধরন দেখা গেছে।
আমাদের কাছে এখনো আমাদের এই অপ্রত্যাশিত ধরনের পুরোপুরি ব্যাখ্যা নেই। প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ বলে যে জনমিতিক ফ্যাক্টরগুলোর কারণে (তরুণ জনগোষ্ঠীর আধিক্য, নিম্নস্থূলতা হার ও পরীক্ষিত রোগ প্রতিরোধক্ষমতা) অনেক নিম্ন আয়ের দেশ সুফল পেয়েছে। আরো বিস্ময়ের বিষয় হলো, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও দরিদ্র দেশগুলো অননুমেয় সাফল্য দেখিয়েছে।
নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ আঙ্গাস ডিটন তার এক নতুন গবেষণায় যেমনটা দেখিয়েছেন, অন্তত স্বল্পমেয়াদের জন্য হলেও মহামারীর ফলে বৈশ্বিক অসমতা কমেছে। গত এক বছর দরিদ্র দেশগুলোর চেয়ে ধনী দেশগুলোয় মাথাপিছু আয় কমেছে। ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে একটি অপ্রত্যাশিত সমরূপতা তৈরি হয়েছে। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে প্রতি মিলিয়নে অধিক লোকের মৃত্যু মানে কেবল জীবন নয়, বড় মাত্রায় আয় হারানোও বটে।
এটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ যে এ ধরন চীন দ্বারা চালিত নয়। জনসংখ্যা-ভারিত মানদণ্ড বলে যে বৈশ্বিক অসমতা কিছুটা বেড়েছে। কারণ চীন (যেটি এখন আর দরিদ্র দেশ নয়) গত বছর অন্যদের সামনে টেনে নিয়ে গেছে। আবার জনসংখ্যা-অভারিত মানদণ্ডে (যেটি চীনকে বাদ দেয়) বৈশ্বিক অসমতা লক্ষণীয় কমার প্রতিফলন দেখা যায়।
অসমতা কমার বিষয়টি বরাবরই একটি ইতিবাচক অগ্রগতি, অন্তত উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে আন্তঃদেশগুলোয় জীবনমানে বিপুল পার্থক্য ঘোচানোর ক্ষেত্রে। তবে কভিড-১৯ অভিজ্ঞতা অনেকটাই ব্যতিক্রম বলা চলে। চলমান মহামারীতে বৈশ্বিক অসমতা কমেছে এই কারণে নয় যে দরিদ্র দেশগুলো ধনী হয়েছে, বরং আর্থিক অভিঘাতে ধনী দেশগুলো তুলনামূলকভাবে দরিদ্র হয়েছে।
এ ধরনের সমরূপতা বা এককেন্দ্রাভিমুখতার নেতিবাচক নীতিগত প্রভাবও রয়েছে। যদিও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো আপেক্ষিক অর্থে ভালো করেছে কিন্তু চূড়ান্ত অর্থে তাদের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই বিবর্ণ। অনেকেই এখন ঊর্ধ্বমুখী ঋণ, ধীর প্রবৃদ্ধি, পণ্য রফতানি ও পর্যটন থেকে রাজস্ব হ্রাস এবং রেমিট্যান্স কমার মতো সমস্যার মুখোমুখি।
তদুপরি মানব পুঁজিতে আয় ও বিনিয়োগের একটি হারানো বছরের দীর্ঘমেয়াদি পরিণাম দেখাটাই এখন বাকি রয়েছে। কয়েক মিলিয়ন শিশু (বিশেষ করে মেয়ে শিশু) এক বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে পারেনি। একই সঙ্গে কয়েক মিলিয়ন নারী মাতৃস্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হয়েছেন এবং আরো কয়েক মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হয়েছে।
সামনে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। এই অপ্রত্যাশিত সমরূপতা-এককেন্দ্রাভিমুখতার প্রকৃতি ইঙ্গিত দেয় যে উন্নত অর্থনীতিগুলোর দরিদ্র দেশগুলোয় সম্পদ সঞ্চালনে কম আগ্রহ থাকবে—হোক তা সরাসরি সহায়তা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগে উন্মুক্ততা কিংবা ঋণ মওকুফ ধরনের সহায়তা। ঘরে বেড়ে চলা অসমতায় ভারাক্রান্ত হয়ে উচ্চ আয়ের দেশগুলো আরো বেশি অভ্যন্তরমুখী হবে। ফলে বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিপরীতে তাদের নিজস্ব নাগরিকরাই অধিক প্রাধিকার পাবে।
উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পিছু হটা অন্যদের জন্য সেখানে উন্মুক্ততার পথ সুগম করবে। বিশেষ করে চীন ওইসব দেশের প্রতি এখন বেশি মনোযোগী হবে, যেটি এরই মধ্যে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে। সুরক্ষাবাদী মনোভাবের ফলে আকর্ষণীয় পশ্চিমা বাজারগুলো অধরা হওয়ায় সম্প্রতি স্বাক্ষরিত রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের মতো চীনকেন্দ্রিক বিকল্প উদ্যোগগুলো উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর কাছে অব্যাহতভাবে আকর্ষণীয় হবে। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নিম্ন সুদহারের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে মূলধন প্রবাহ চালিত হবে। তবে তাই যদি হয় তাহলে ওই দেশগুলোকে কেবলই একটি ক্ষুদ্র উচ্চশ্রেণীকে ধনী করার পরিবর্তে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন ত্বরান্বিত করতে মূলধন আন্তঃপ্রবাহ নিশ্চিতে বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও দূরদর্শী নীতি নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সম্পদের ঘাটতি সত্ত্বেও সব দেশকেই তাদের মানব পুঁজি এবং নিজস্ব অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। অনেক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাজেটের চেয়ে সদিচ্ছাই বড় ব্যাপার। উদাহরণস্বরূপ, শক্তিশালী স্কুল মানে কেবল উন্নত অবকাঠামো ও বিপুল বিনিয়োগ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে সেখানে শিক্ষকদের উপস্থিতি ও নৈপুণ্য নিশ্চিত এবং শিক্ষার্থীদের কাছে যথাযথ পাঠ্যবইয়ের লভ্যতা নিশ্চিতেরও ব্যাপার। সামনের দিনে বিদ্যমান সম্পদের কার্যকর ব্যবহার এবং কার্যকর বাস্তবায়ন আগের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হবে। ধনী দেশগুলো যেহেতু দরিদ্র হচ্ছে, সেহেতু দরিদ্র দেশগুলোকে অবশ্যই বিষয়গুলো নিজের আয়ত্তে রাখতে হবে। নিজস্ব সম্পদ সঞ্চালন বাড়াতে বিভিন্ন উদ্ভাবনী উপায়ের মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। নইলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মোকাবেলা করা সহজ হবে না। [স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট] পিনেলোপি কোজিয়ানো গোল্ডবার্গ: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউর প্রধান সম্পাদক এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক দৈনিক বণিক বার্তার সৌজন্যে ভাষান্তরে- হুমায়ুন কবির
উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পিছু হটা অন্যদের জন্য সেখানে উন্মুক্ততার পথ সুগম করবে। বিশেষ করে চীন ওইসব দেশের প্রতি এখন বেশি মনোযোগী হবে, যেটি এরই মধ্যে প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরেছে। সুরক্ষাবাদী মনোভাবের ফলে আকর্ষণীয় পশ্চিমা বাজারগুলো অধরা হওয়ায় সম্প্রতি স্বাক্ষরিত রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের মতো চীনকেন্দ্রিক বিকল্প উদ্যোগগুলো উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতিগুলোর কাছে অব্যাহতভাবে আকর্ষণীয় হবে। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নিম্ন সুদহারের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে মূলধন প্রবাহ চালিত হবে। তবে তাই যদি হয় তাহলে ওই দেশগুলোকে কেবলই একটি ক্ষুদ্র উচ্চশ্রেণীকে ধনী করার পরিবর্তে ব্যাপকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য বিমোচন ত্বরান্বিত করতে মূলধন আন্তঃপ্রবাহ নিশ্চিতে বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও দূরদর্শী নীতি নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সম্পদের ঘাটতি সত্ত্বেও সব দেশকেই তাদের মানব পুঁজি এবং নিজস্ব অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে বিনিয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে। অনেক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাজেটের চেয়ে সদিচ্ছাই বড় ব্যাপার। উদাহরণস্বরূপ, শক্তিশালী স্কুল মানে কেবল উন্নত অবকাঠামো ও বিপুল বিনিয়োগ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে সেখানে শিক্ষকদের উপস্থিতি ও নৈপুণ্য নিশ্চিত এবং শিক্ষার্থীদের কাছে যথাযথ পাঠ্যবইয়ের লভ্যতা নিশ্চিতেরও ব্যাপার। সামনের দিনে বিদ্যমান সম্পদের কার্যকর ব্যবহার এবং কার্যকর বাস্তবায়ন আগের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হবে। ধনী দেশগুলো যেহেতু দরিদ্র হচ্ছে, সেহেতু দরিদ্র দেশগুলোকে অবশ্যই বিষয়গুলো নিজের আয়ত্তে রাখতে হবে। নিজস্ব সম্পদ সঞ্চালন বাড়াতে বিভিন্ন উদ্ভাবনী উপায়ের মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। নইলে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ মোকাবেলা করা সহজ হবে না। [স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট] পিনেলোপি কোজিয়ানো গোল্ডবার্গ: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউর প্রধান সম্পাদক এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক দৈনিক বণিক বার্তার সৌজন্যে ভাষান্তরে- হুমায়ুন কবির
এই বিভাগের আরো সংবাদ