আজকের শিরোনাম :

স্মৃতিতে বঙ্গবন্ধু

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০১৮, ১২:৪৪

মো. সিরাজুল ইসলাম, ২৫ আগস্ট, এবিনিউজ : আগস্ট বাঙালির শোকের মাস। এই মাসটির নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে বাঙালি-হৃদয় যন্ত্রণাদগ্ধ হয়, শোকে মুহ্যমান হয় বাঙালি-আত্মা। হৃদয়পটে ভেসে ওঠে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মর্মন্তুদ হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঠিক নেতৃত্বে, সংগ্রাম, লড়াই, আন্দোলন, ত্যাগ-তিতিক্ষার পর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ করে নৈতিকতাবর্জিত হানাদার বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন। দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ বাঙালি শহিদ হন, তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের ১ কোটিরও বেশি মানুষকে আশ্রয় দেয়। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযোদ্ধাদিগকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে চাহিদা মোতাবেক অস্ত্রের জোগান দেন। তাদের নিয়মিত সেনাবাহিনীর একটি অংশ সার্বিক সহযোগিতা করে।

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষে জনমতের জন্য সারাবিশ্ব ঘুরে বেড়ান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি আরবের মতো পরাশক্তির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের ঝুঁকি নেন। বাঙালি জাতি চিরদিন পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে ভারতের এ অবদান, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাহসী ভূমিকার কথা স্মরণ করবে। এ ঋণ অপরিশোধযোগ্য। আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের হুমকি-ধমকিকে থোড়াই তিনি বিবেচনায় নেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সর্বাত্মক সহযোগিতা না পেলে স্বাধীনতা অর্জনে বহু সময় লাগত। আরও অনেক রক্তপাত হতো। জানমালের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব অকল্পনীয়।

আগস্ট মাস এলে কত স্মৃতি, কত কথা, কত ঘটনা মনে পড়ে। মনে পড়ে পাকিস্তান সৃষ্টিতে ধর্মের দোহাই পশ্চিমাদের একটি ভাঁওতাবাজি ছিল। ধর্মের দোহাই দিয়ে শুরুতেই তারা পূর্ব বাংলার মানুষকে শোষণ ও শাসন করতে শুরু করে।

১৯৪৭-৪৮ সালে পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ৬ কোটি ৯১ লাখ। তার মধ্যে পূর্ব বাংলার ৪ কোটি ৪০ লাখ। অথচ নতুন রাষ্ট্রের প্রথম জাতীয় সংসদ অধিবেশনে (ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮) করাচিতে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান উর্দুকে রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে প্রস্তাব আনেন। বাঙালি কংগ্রেস সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেন। অধিকাংশ লোকের ভাষা বাংলাকেও রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এসব কারণে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র চার মাস পরে জানুয়ারি ১৯৪৮ সালে অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ছাত্রলীগের জন্ম। অতঃপর মাত্র দেড় বছর পর রাজনৈতিক দল, মুসলিম লীগকে ঠেকাবার জন্য আওয়ামী লীগের সৃষ্টি ২৩ জুন ১৯৪৯-এ।

আমার ছোট মামা অধ্যাপক আবদুল লতিফ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের এককালের ‘ব্লু’ একমাত্র চাচা শামসুল হক সাহেব (উনারা উভয়েই ছাত্রাবস্থায় ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। শত শত ছাত্রের সঙ্গে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলেও গিয়েছিলেন) তাদের কাছে পাকিস্তান সৃষ্টির গণ-আন্দোলন, দ্বি-জাতি তথ্য, মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহরু, তার ছেলে জওহরলাল নেহরু, সি আর দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান- ভারত বিভাগের জন্য কারা দায়ী, কীভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে ধোঁকাবাজির মধ্যে পাকিস্তানের জন্ম, এসব তথ্য ও ইতিহাস শুনতে অভ্যস্থ হই। প্রায়শ এসব বিষয় নিয়ে আমাদের বাড়িতে আলোচনা, চুলচেরা তর্কাতর্কি হতো। খুব মন দিয়ে শুনতাম, ভালো লাগত। শিশু অবস্থায় মনে-প্রাণে একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়।

কবি, সাহিত্যিকের বিশেষ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শরৎ চন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- এসব মনীষীর নানা প্রসঙ্গে উনারা সুযোগ পেলেই আলোচনা করতেন। গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করতাম। এসব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কবি-সাহিত্যিকদের সম্বন্ধে জানার ও দেখার প্রবল ইচ্ছে সবসময় মেঘে ঢাকা আলোকরশ্মির মতো মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারত।

যখন নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করি তখন ঢাকা বেড়াতে এসে ১৯৬০ সালে পল্টন ময়দানে এক আত্মীয়ের সঙ্গে প্রথম শেরেবাংলা একে ফজলুল হক সাহেবকে দেখার সৌভাগ্য হয়। অবিভক্ত বাংলার রাজধানী কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র, বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তিনি বাংলার মানুষকে ঋণ-প্রথা থেকে মুক্ত করেন। পূর্ব বাংলার প্রতিগ্রামে শিক্ষার আলো বিতরণের ব্যবস্থা করেন। বিশাল মুখায়ব, বড় বড় চোখ, উঁচু ধারাল নাক ও ললাটের বিশাল দেহ। ভুঁড়ি নাভির নিচে নেমে এসেছে। অনেক বয়স, কিছু দাঁত না থাকায় বক্তৃতা বুঝা যাচ্ছিল না। এই মহান পুরুষকে দেখাই আমার মূল উদ্দেশ্য। দেব দর্শন আমার হলো। ১৯৬২ সালে যখন মেট্রিক পরীক্ষা দেই, পরীক্ষার মাঝে তিনি এই মাটির পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। যদি সেদিন চাক্ষুস দেখা না হতো, তবে সারাজীবন আফসোস থেকে যেত। এই মহান বাঙালি মনীষীকে দেখার সুযোগ আর কখনও হতো না।

১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে বগুড়া শহরে পরম শ্রদ্ধেয়, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখার, খুব কাছ থেকে বক্তৃতা শোনার সুবর্ণ সুযোগ ঘটে। বগুড়া আজিজুল হক কলেজে তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করি। ১৯৬২-এর ফেব্রুয়ারিতে জননিরাপত্তা আইনে তাদের কারাগারে পাঠান। জুন মাসে মুক্তি দেয়। তারা বিরোধীদলীয় ঐক্যজোট গঠন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরে বগুড়া আসেন। একমাত্র রাস্তা রেলপথ। যেখানে দুপুর ১২-১টায় বগুড়া পৌঁছার কথা, সেখানে পৌঁছান বিকেলে। শহীদ সাহেব বয়স্ক, অসুস্থ এবং জার্নিতে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাড়াহুড়ো করে সার্কিট হাউসে কিছু খাওয়া-দাওয়া করেই মঞ্চে আসেন। মনে হলো বগুড়া জেলার সব লোক জড়ো হয়েছে। সবার একই কথা সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বক্তৃতা শুনব। মঞ্চের খুব কাছে ছিলামÑ যেমন ছিলাম ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ‘অবিস্মরণীয়’ ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত সেই উত্তাল জনতার মাঝে ভাষণের সময়। শহীদ সাহেব বলেন, “ভাইসবÑ আমি কিছু বলিবার আগে আমার ছোট ভাই মুজিব কিছু বলিবে।

আপনারা শুনবেন?” বিশাল জনতা দু-হাত তুলে জানালেন, আমরা শেখ মুজিবের ভাষণ শুনব। বঙ্গবন্ধু তখন তরুণ, তার স্বভাবসুলভ আচরণ করে প্রথমেই দু-হাতের পাঞ্জাবির হাতা গোটালেন, চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন, শুরু করলেন। “আমার স্বাধীন দেশের পরাধীন ভাইয়েরা, সামান্য কিছুক্ষণ বক্তৃতা দিয়ে পাকিস্তানিদের শোষণ-শাসন, অন্যায়-অবিচারের কথা বুঝানো যাবে না।” প্রায় ৪০ মিনিট যেন তিনি একটি কবিতা পাঠ করলেন। হাজার হাজার মানুষ; কিন্তু পিনপতন নীরবতা। মানুষ কেমন যেন হিমনুটাইজড হয়ে গেছে, এ তো বক্তৃতা নয়, সমস্ত বাঙালির মনের কথা, প্রাণের কথা, হৃদয়ের ব্যাকুলতা। যে-কথা মানুষকে সহসাই জাগিয়ে তোলে। হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে ফিরে পাবার প্রবল আকাক্সক্ষা জাগিয়ে তোলে, অচেতন মানুষ তার চেতনা ফিরে পায়। জীবনে বঙ্গবন্ধুর অনেক বক্তৃতা শুনেছি; কিন্তু সেদিনের ঐ যে, “আমার স্বাধীন দেশের পরাধীন ভাইয়েরা” ঐ উদ্দীপনা-ব্যাকুলতা আর কোথাও দেখেনি ৭ মার্চ ১৯৭১-এর ভাষণ ছাড়া।

আমার কেন জানি সেদিন মনে হয়েছিল বাঙালি তো এই নেতার জন্য হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করছে। এই তো সুভাষ বসু, এই তো ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন। ১৯৭১ সালে তা-ই প্রমাণ হলো। তিনি জাতির পিতা হলেন, লাল-সবুজের পতাকা দিলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন। বাঙালি হলেন। বাঙালির জন্য স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করলেন।

পরের বছর ১৯৬৩-তে ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী সাহেব ভূমধ্যসাগরের তীরের বৈরতে এক হোটেল একাকী নিঃসঙ্গভাবে দেহত্যাগ করেন। যদি ঐদিন বগুড়াতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে না দেখতাম, সারাজীবনভর আফসোস থেকে যেত। আমি পরম ভাগ্যবান যে মামা-চাচার গল্পের শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ বাঙালি ব্যক্তিত্বকে স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রজীবনের পরপরই ১৯৬৯ সালে রাজশাহীতে অধ্যাপক ড. মাজহারুল ইসলাম স্যারের বাসায় মতিহারে দেখার ও কথা বলার সুযোগ হয়। ঘটনাটি এভাবে বলা যেতে পারে- ১৯৬৮ সালে ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ১নং আসামি এবং ৩৫ জন বাঙালি সেনা ও সিএসপি অফিসারকে অভিযুক্ত করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করেন। ১৭ জানুয়ারি রাত ১২টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে জেলগেটেই সামরিক বাহিনীর লোকজন দিয়ে পুনরায় গ্রেফতার করেন। সেখান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এনে এক অন্ধকার কারা প্রকোষ্টে নিক্ষেপ করেন। সারাকক্ষ গাঢ় লাল রঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা। বঙ্গবন্ধুর চৌকির পাশে আর এক চৌকিতে অস্ত্রসহ সবসময় একজন সেনা কর্মকর্তা থাকতেন। হেন অত্যাচার-টর্চার নেই, যা করা হয়নি।

বাধ্য হয়ে একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে যে কোনো প্রকারে একটি চিঠি লিখেন, যাতে তার প্রতি ন্যূনতম মানবিক আচরণ করা হয়। আইয়ুব খান চিঠি পান এবং ন্যূনতম মানবিক আচরণের নির্দেশ দেন। [সূত্র : কারাগারের রোজনামচা]। লাল পর্দা দেবার উদ্দেশ্য যাতে তিনি তাকাতে না পারেন। যা বলছিলাম রাজশাহীর ঈদগাঁ মাঠে ভাষণ প্রদান সম্পর্কে। ঐ বছর ১৯৬৯ সালে সারা পূর্ব পাকিস্তানে দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের বিরামহীন আন্দোলন, ১৪৪ ধারা লঙ্ঘন। শ্রমিক লীগের কারফিউ আমান্যকরণ এবং একপর্যায়ে ক্যান্টনমেন্টের ফটক ভাঙন। যেখানে বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয়েছিল- সেই গেটের তালাও ভেঙে ফেলা হয়। ভীত হয়ে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। বের হয়েই তিনি সারাদেশে রাজনৈতিক সফর শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে অক্টোবর মাসে রাজশাহী আসেন। মতিহারে স্যারের বাসায় আমরা কয়েকজন ছাত্রনেতা দেখা ও কথা বলার সুযোগ পাই। তিনি একপর্যায়ে বলেন, “তোরা নির্দেশ মোতাবেক কাজ করে যা, লেট-দা টাইম কাম।”

অতঃপর ’৭০-এর নির্বাচন, আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ধারাবাহিকভাবে নানা ঘটনা, বাংলাদেশ অর্জন, ’৭৩-এর নির্বাচন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুব কাছে যাবার আর তেমন সুযোগ হয়নি। মাঝে একবার ১৯৭২ সালে ১০ অক্টোবর বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারে ভূষিত করার পর ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের কলেজের সব অধ্যাপকগণ অধ্যক্ষ আলতামাসুল ইসলাম সাহেবের নেতৃত্বে ফুলের তোড়া উপহার দিতে যাই গণভবনে। শত শত দেশি-বিদেশি নেতা-কর্মীদের ভিড়। এর মধ্যেই আমাদের সময় দেন। কুশলবিনিময়ের পর বলেন, “চোরে দেশ ভর্ত্তি হয়ে গেছে। তোমরা দেশে সৎ নাগরিক গড়ে তুলবে, সৎ মানুষ বানাবে যাতে তারা সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারে।” হৃদয়ের গভীরে কথাগুলো অহর্নিশি প্রেরণা জোগায়।

১৯৭৩ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের প্রথম বিসিএস ব্যাচে ক্যাডারভুক্ত হবার পর আমাকে ১নং দিয়ে ২০০ কর্মকর্তার একটি নতুন ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়। আমরা ৫০-৬০ জন অফিসার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাকে চিনতে পেরে বলেন, “কিরে কলেজ ছেড়ে বিসিএস-এ যোগদান করেছিস, খুব ভালো হয়েছে। এই ক্যাডার-আইএমএস (ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস) আমার নিজস্ব সৃষ্টি। আমি গাছ লাগিয়েছি, এর পরিচর্যা আমি করব। তোরা দেশে-বিদেশে দুই বৎসর প্রশিক্ষণ নিবি। চোর, অসৎ কর্মকর্তা, কর্মচারীদের হাত থেকে আমার মিল ফ্যাক্টরি, কল-কারখানা রক্ষা করবি। তোদের মতো সুশিক্ষিত, চৌকস কর্মকর্তা আমার প্রয়োজন। ৫ বৎসরের মধ্যে সচিব পর্যায়ের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সমস্ত কল-কারখানার দায়িত্ব তোদের হাতে তুলে দেয়া হবে।”

দেশে বিএমডিসি-তে এক বৎসর প্রশিক্ষণের পর পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সবাইকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ১৫ আগস্ট ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্যাডারটি বিলুপ্ত করে সব মিল-ফ্যাক্টরি পর্যায়ক্রমে ব্যক্তি মালিকানাধীনে ছেড়ে দেয়। আমাদের ৫টি ক্যাডারে (পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পোস্টাল, রেলওয়ে ও পুলিশ) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমি প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেই।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫, আমি ডেপুটেশনে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে কর্মরত। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ ও সর্বাধুনিক নিউজপ্রিন্ট মিল। কর্মকর্তা, কর্মচারী, শ্রমিক সবার জন্য বাসাবাড়ি নিয়মিত। নিজস্ব পাওয়ার হাউস (২৫ মেগাওয়াটের)। সবার জন্য দুটি হাসপাতাল, তিনজন এমবিবিএস ডাক্তার, মেটারনিটিসহ সকল প্রকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত। স্কুল, মাদ্রাসা, পোস্ট অফিস, ফায়ার সার্ভিস, ৩টি খেলার মাঠ, সুইমিংপুল, সবার জন্য যানবাহন। তিন শ্রেণির ক্লাব। কী ছিল না?

সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ দিয়ে এর সঙ্গে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বিদেশি পাল্প মিশিয়ে উন্নতমানের নিউজপ্রিন্ট তৈরি করা হতো। দেশের সকল পত্রিকাকে যার যার প্রয়োজনমাফিক সরবরাহ করেও অর্ধেকের বেশি ভারত, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হতো। পত্রিকার মালিকগণ ডিলারদের চেয়ে প্রতিটনে ২ হাজার টাকা কম মূল্যে নিউজপ্রিন্ট পেতেন। তাই পত্রিকা মালিকগণ মিথ্যা প্রত্যয়নপত্র জোগাড় করে, যার যা প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কাগজ নিতেন। অসৎ রোজগারের মহোৎসব। যার লাগত ৫ টন, তিনি ডিকলারেশন নিতেন ২৫ টনের। ঢাকায় বসে প্রতিটনে এক/দেড় হাজার টাকা কম মূল্যে ডিলারদিগকে কাগজ বিক্রি করতেন। সত্তর দশকের শেষ দিকে পত্রিকা মালিকদের এর চেয়ে বড় ব্যবসা অন্যকিছু ছিল না। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন থেকে প্রতিযোগিতামূলক তদবির করে যে যত টন বেশি নিতে পারে। আর কী! যে মিলের এত সুনাম, এত রমরমা, আনন্দ উৎসব, আয়-রোজগার, সেই মিল এখন সম্পূর্ণ অচল। সব কিছুই স্থবির। ২০০ একর জমি মিলের সম্পত্তি। কোথায় হারিয়ে গেল সেই খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিল? ভাবতে খুব কষ্ট হয়। এদেশে সব সম্ভব। জেনারেল জিয়াউর রহমান পত্রিকা মালিকগণকে খুশি রাখার জন্য ডিলার এবং পত্রিকার জন্য মূল্যের এই তারতম্য করেছিলেন।

’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই ভয়াবহ হৃদয়বিদারক, বাঙালির দুর্ভাগ্যের খবরটি কীভাবে পেলাম তাই বলছি। তখন তো আর মোবাইল ফোন ছিল না। টেলিভিশনেরও এত বহুল প্রচার নেই। সকালে যথারীতি অন্যান্য দিনের মতো প্রস্তুত হয়ে অফিসে যাবার জন্য ফ্ল্যাট থেকে নিচে নামছি। গাড়ি দাঁড়ানো। এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের দোতলা থেকে এক সহকর্মীর স্ত্রী চিৎকার দিয়ে বলছেন- ‘ভাই কোথায় যাচ্ছেন?’ তিনি কাঁদছেন। দুচোখ বেয়ে লোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি বললাম- ‘কেন? কি হয়েছে?’ তিনি বললেন- ‘ঘরে যান, টিভি দেখেন, আমি বলতে পারব না’- বলেই দৌড়ে ভিতরে চলে গেলেন।

ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে? সেও কিছু বলতে পারল না। এমন সময় দেখি প্রোডাকশন ম্যানেজার মমতাজ সাহেব গাড়ি নিয়ে মিল থেকে ফিরে আসছেন। আমাকে দেখে গাড়ি থেকে মুখ বের করে বললেন, ‘ইসলাম সাহেব বাসায় যান, মিলে যেতে হবে না।’ চারদিকে ছমছম কেমন একটা ভাব। মমতাজ সাহেব নিমিষে উধাও হয়ে গেলেন। তার চোখেও পানি। ব্যাপার কি, পশু-পাখি, গাছের পাতা পল্লব কেমন যেন নীরব নিস্তব্ধ। কাউকে কোথাও দেখছি না। সবাই বোধহয় যার যার ঘরে টিভি কিংবা রেডিও শুনছিল। বাঙালির এত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে।

জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে এমন কুচিন্তা আমার মাথায় কোনোমতেই আসছিল না। আমি ভাবছি দেশে সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটেছে হয়তো। সবাই এমন ভাব করছে, বলছে- ‘আমার মুখ দিয়ে এ কথা বলতে পারব না।’ আস্তে আস্তে ঘরে এসে টিভি খুললাম, এ কি? বারবার বলছে মেজর ডালিম বলছি... খন্দকার মোস্তাক বঙ্গভবনে। নতুন সরকার গঠনের পায়তারা করছে। আমি ধপ করে পড়ে জ্ঞান হারালাম। বাসায় কাজ করার শফিক হয়তো ডা. মল্লিককে নিয়ে আসে। আমার পরিবারের অন্য সদ্যসরা তখন ঢাকায় ছিল। বেলা অনুমান ১২টায় ডাক্তার মল্লিক আমাকে শুশ্রুষা করে স্বাভাবিক করেন। দেখি বাসায় আমার আশপাশের অনেক লোক, শুধু বললাম এদেশে এও কি সম্ভব? জাতি হাজার বছর পিছিয়ে গেল। হাজার বছরেও এ ক্ষতি পূরণ হবার নয়। সব সম্ভবের দেশ- এ বাংলাদেশ। আমার স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনায় এ ধরনের কর্মকা--নিষ্ঠুরতা কল্পনারও অতীত। স্মৃতি বড় নিষ্ঠুর, বড় হৃদয় বিদারক।

লেখক : সাবেক যুগ্ম সচিব; সভাপতি, বাঞ্ছারামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ

এই বিভাগের আরো সংবাদ