আজকের শিরোনাম :

রথীন্দ্রনাথ রায়ের জন্মদিনে শুভ কামনা

  জয়ন্ত কুমার রায়

২৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৩:১৯ | অনলাইন সংস্করণ

জীবন্ত কিংবদন্তী স্বাধীন বাংলা বেতার সঙ্গীতশিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায় মাতুল এর শুভ জন্মদিনে স্বস্ত্রীক প্রণাম সহ সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ্যায়ু কামনা করছি।

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান লোকশিল্পী। তিনি মূলতঃ বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে প্রচলিত লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী হলেও দেশাত্মিতি্‌ ভক্তিগীতি,বাউলাঙ্গ ও বাংলা চলচিত্রে গান গেয়ে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন। তিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে গান পরিবেশন করে মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালন করেন এবং কণ্ঠযুদ্ধশিল্পী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে ১১ টি সেক্টর নয় মোট ১২ টি সেক্টর তন্মদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার একটি সেক্টর ।সেই স্বাধীন বাংলা বেতারের কণ্ঠ শিল্পীবৃন্দরা বীর মুক্তিযোদ্ধা। 

রথীন্দ্রনাথ রায়: ১৯৪৯ সালের ২৩ জানুয়ারি নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর থানার অন্তর্গত সুবর্ণখুলী গ্রামে সম্ভ্রন্ত ভূস্বামী পরিবরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা অন্যতম লোকসঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার স্বর্গীয় হরলাল রায় ও মাতা  স্বর্গীয় বীণা পানি রায়। তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে রথীন্দ্রনাথ রায় দ্বিতীয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া রথীন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী ঢাকার বিশিষ্ট আইনজীবী স্বর্গীয় প্রমোদ চন্দ্র বোসের কন্যা সন্ধ্যা রায়। এই দম্পতির এক মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ে চন্দ্রা রায়, ছেলে দুজন হলেন দীপ্ত রায় ও রঙ্গন জ্যোতি রায়।    

তিনি ছোটবেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি গভীর অনুরক্ত ছিলেন। খুব ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে রথীন্দ্র রায় বলেন, ‘আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায় আমার বাবা বেশ কয়েকজনকে নিয়ে গানের আসর বসাতেন। সেখানে গানও শেখাতেন তিনি। তো আমি, আমার পিসি রমাপতি রায়, দিদি প্রতিমা রায় ও ছোট কাকু ব্রজেন রায় স্কুল ছুটির শেষে বাসায় চলে আসতাম যথারীতি। বিকেলে অন্যরা বিশ্রাম নিলেও আমি বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাবার গান শেখানো খুব খেয়াল করতাম। পরেরদিন স্কুল ছুটি হতেই বাবার গানের ডায়েরি নিয়ে ধান ক্ষেতের আইলে বসে চিত্কার করে বাবার আগেরদিনের গান একইরকমভাবে গাইবার চেষ্টা করতাম। এভাবেই আমি গানের চর্চা করতাম।’ এভাবেই ধীরে ধীরে রথীন্দ্র নাথ রায় নিজেকে একজন সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু করেন। বাবার কাছেই সঙ্গীতের প্রাথমিক তালিম গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ওস্তাদ পি.সি. গোমেজের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। আট বছর বয়সে তিনি বেতারে ও তের বছর বয়সে টেলিভিশনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। 

স্কুলে পড়াকালীন ১৯৬০ সালে তদানীন্তন রেডিও পাকিস্তান আয়োজিত ‘ফোক ফেস্টিভ্যাল’-এ রথীন্দ্র নাথ রায় তার বাবার লেখা একটি ভাওয়াইয়া গান এককভাবে পরিবেশন করেন। পরে ১৯৬২ সালে আবারও একই  ফেস্টিভ্যালে সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হলে পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসেই রথীন্দ্র নাথ রায় টিভিতে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯৬৬ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পর ঢাকায় এসে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য থেকে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৫ সাল থেকেই রথীন্দ্র নাথ রায়ের অসাধারণ গায়কী নিয়ে সেই সময়ের সংবাদপত্র দৈনিক বাংলা, পূর্বালী, চিত্রালীতে বেশ লেখালেখি হতো। আর এরপর তো শুরু হলো গণআন্দোলন। রথীন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘আমারই চোখের সামনে আসাদ মারা গেল। তার রক্তাক্ত লাশ নিয়ে মিছিল করেছি। সেই দৃশ্য আজও চোখে ভেসে উঠে।’ রথীন্দ্র নাথ রায় সবসময়ই গর্ব অনুভব করেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শিল্পী হিসেবে। তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।

রথীন্দ্রনাথের কণ্ঠে যেসব ভাওয়াইয়া গান ব্যাপক শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ও মোর সোনার কন্যারে’, ‘বাপৈই চেংরারে’, ‘কে বলে মানুষ মরে’, ‘যৌবন জোয়ার একবার আসেরে’, ‘আমি কী তোর আপন ছিলাম না রে জড়িনা’, ‘ফুলবানু তুই মনের আগুন জ্বালাইস না’, ‘আমি কেমন করে পত্র লিখিরে’ ' ওকি গারিয়াল ভাই , ওকি ও কাজল ভ্রমরা রে,' ইত্যাদি। ভার্সেটাইল ঘরানার কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় প্রথম চলচ্চিত্রে গান করেন খান আতাউর রহমানের ‘সাত ভাই চম্পা’তে ১৯৬৬ সালে। এরপর তার কণ্ঠে যেসব চলচ্চিত্রের গান শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘হায়রে কথায় বলে গাছে বেল পাকিলে’ (সুজন সখি), ‘খোদার ঘরে নালিশ করতে দিলো না আমারে’ (নালিশ), ‘তুমি আরেকবার আসিয়া যাও মোরে কান্দাইয়া’ (নাগরদোলা), ‘হীরামতি হীরামতি ও হীরামতি’ (সারেং বউ), ‘সবাই বলে বয়স বাড়ে আমি বলি কমেরে’ (ফকির মজনুশাহ), ‘ও যার অন্তরে বাহিরে কোনই তফাত্ নাই’ (অন্ধবধূ) ইত্যাদি। প্রায় চল্লিশটি চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে যে গান তার কণ্ঠে গর্জে উঠেছিল, তার কয়েকটি হলো ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবোরে’, ‘আমারই দেশ সব মানুষের’, ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি’, ‘ভেব না গো মা তোমার ছেলেরা হারিয়ে গেছে পথে’ ইত্যাদি। এসব গান তো এখন ইতিহাস হয়ে আছে বাংলাদেশে। আর সেই ইতিহাসের প্রধান একজন সাক্ষী জীবন্ত কিংবদন্তী আমাদের রথীন্দ্রনাথ রায়।

১৯৭৩ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব যুব উত্সব’-এ ১৮০টি দেশের সঙ্গীতশিল্পীদের প্রতিযোগিতায় দেশাত্মবোধক গানে শ্রেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে পুরস্কার লাভ করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ রায় আর এটাই তার সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন। তবে 'নাগরদোলা’ (১৯৭৯) এবং ‘অন্ধবধূ’ (১৯৮১)-তে গান গাওয়ার জন্য ‘বাচসাস’ পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ১৯৯৪ সালে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন এই গুণী শিল্পী।

লেখকের ফেসবুক থেকে সংগৃহিত

এই বিভাগের আরো সংবাদ