আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনা দরকার

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০১৮, ১৩:৪০

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, ১৫ মে, এবিনিউজ : বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এবার কর্মকর্তা নির্বাচনের পালা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শীর্ষ কর্মকর্তা মনোনয়নের কাজটি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। অসংখ্য প্রার্থীর মধ্যে সঠিক ও যোগ্য প্রার্থী বাছাই করার কাজটি সহজ নয়। এ জন্য হয়তো দু-এক দিন সময় লাগবে। হয়তো আমার এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার সময়ে বা কিছু পরে এই শীর্ষ কর্মকর্তাদের নাম জানা যাবে।

শেখ হাসিনার মনোনয়নে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরাই ছাত্রলীগের নতুন কর্মকর্তা হবেন—এটা আমার আশা। এত দিন এক বা একাধিক সিন্ডিকেটের ভূত ছাত্রলীগের কাঁধে সওয়ার হয়ে বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া দলটিকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই ঐতিহাসিক ছাত্রসংগঠনটির সব গৌরব ম্লান হতে বসেছিল ছাত্রলীগ পরিচয়ধারী এবং দলটিতে অনুপ্রবেশকারী এক শ্রেণির ছাত্র ও অছাত্রের সন্ত্রাস ও অন্তর্দ্বন্দ্বে।

শেখ হাসিনাকে তাই সতর্ক ও কঠোর হতে হয়েছে। সিন্ডিকেটের দখলদারি ও দুর্নীতি থেকে দলটিকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হয়েছে। লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে দলের একটি পদ পাওয়ার যে জঘন্য প্রথা চালু হয়ে গিয়েছিল তা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই প্রথাগুলো বিএনপির ছাত্রদল থেকে ছাত্রলীগে এসে ঢুকেছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে সৈয়দ আশরাফ একবার বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসতেই পরিচয় বদল করে ছাত্রলীগে ঢুকে যারা ছাত্রলীগার সেজেছে, তাদের দৌরাত্ম্যেই ছাত্রলীগের সুনাম নষ্ট হচ্ছে।’

সৈয়দ আশরাফের এই পর্যবেক্ষণ সঠিক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলে দলে জামায়াতি আওয়ামী লীগে ঢুকেছে এবং দলটির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তেমনি ছাত্রলীগেও ঢুকেছে শিবির ও ছাত্রদলের বহু নেতাকর্মী। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দুর্ভাগ্য, তারা এই অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারেনি এবং এই অনুপ্রবেশকারীদের সব রকম অপকর্মের দায় ছাত্রলীগকে বহন করতে হয়েছে। এই অনুপ্রবেশকারীদের প্রভাব ছাত্রলীগের এক শ্রেণির নেতা ও কর্মীর ওপরও বর্তেছে। এই অনুপ্রবেশকারীদের দল থেকে হটিয়ে এবং তাদের নেতৃত্ব ও প্রভাব থেকে দলটিকে মুক্ত করে তার পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে না পারলে দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অবক্ষয় রোধ করা যাবে না। আশা করা যায়, ছাত্রলীগের এবারের সম্মেলনের পর শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যাঁরা নেতৃত্বে আসবেন, তাঁরা দলটিকে আমূল সংস্কার ও পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করবেন। এই নেতৃত্ব লুটপাট, সন্ত্রাস ও হানাহানির পথে যাবেন না। দেশের ছাত্র ও যুব সমাজের উন্নয়নে বলিষ্ঠ কর্মসূচি গ্রহণ করবেন এবং দেশটিকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে একটি অসাম্প্রদায়িক দেশে পরিণত করার কাজে গঠনমূলক দায়িত্ব পালন করবেন। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিকে দুই সামরিক ডিক্টেটর জিয়াউর রহমান ও এরশাদ যেমন কলুষিত করার ব্যবস্থা করেন, তেমনি কলুষিত করেন ছাত্ররাজনীতিকেও। আগে ছাত্ররাজনীতি ছিল আদর্শ ও আত্মত্যাগের রাজনীতি। সেই রাজনীতিকে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও লাইসেন্স-পারমিটবাজির রাজনীতিতে প্রথম রূপান্তর ঘটান জেনারেল জিয়াউর রহমান। মন্ত্রিত্ব, লাইসেন্স-পারমিটের লোভ দেখিয়ে তিনি ছাত্ররাজনীতিকে বিপথগামী করেন। এরশাদ একে পূর্ণতা দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রাবাসে অছাত্র সন্ত্রাসীদের ছাত্র পরিচয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে এবং তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে। শুরু হয় ছাত্ররাজনীতিতে সশস্ত্র গুণ্ডামি ও হানাহানি।

এরশাদের আগে জিয়াউর রহমান এমন একটি কাজ করেন, যা দেশের ছাত্ররাজনীতিকে আদর্শহীন ও ক্ষমতালোলুপ করে তোলে। ব্রিটিশ আমল, এমনকি পাকিস্তান আমলেও ছাত্ররাজনীতি ছিল দেশের এবং ছাত্র-জনতার দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের ভ্যানগার্ড। জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল আদর্শের, সংগ্রামের। তা অন্ধ আনুগত্য ও নেতাবিশেষের লাঠিয়ালের ভূমিকা ছিল না।

আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে কোনো ছাত্রদল ছিল মুসলিম লীগের অনুসারী। কোনো দল ছিল আওয়ামী লীগ কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী। এসব ছাত্রসংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচিত হতো সাধারণ ছাত্র সদস্যদের ভোটে, মূল দলের মনোনয়ন বা নির্দেশে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ও তার ছাত্রাবাসগুলোতে ছাত্র সদস্যদের দ্বারা নির্বাচনের ভিত্তিতে দলগুলোর কর্মপরিষদ গঠিত হতো। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন ছাত্রসংসদ গঠিত হতো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিভিন্ন হলগুলোতে সাধারণ ছাত্রদের ভোটে। এই ছাত্রসংসদের বাজেট ভোটাভুটির ভিত্তিতে পাস করাতে হতো। পাস না করলে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা ছাড়তে হতো। এটা ছিল পুরোপুরি সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুসরণ। অর্থাৎ ছাত্রদের ছাত্রজীবন থেকেই সংসদীয় গণতন্ত্র শিক্ষা দেওয়া হতো।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই ব্যবস্থা বাতিল না হলেও আর চালু নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ বা ডাকসুর নির্বাচন কবে হয়েছিল তা এখন গবেষণার বিষয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখলের পর তো ছাত্ররাজনীতির স্বাধীন চরিত্রই ধ্বংস করে দেন। তিনি আইন করেন, প্রতিটি ছাত্রসংগঠনকে কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে হবে এবং যুক্ত থাকার প্রকাশ্য ঘোষণা দিতে হবে।

এভাবে ছাত্রসংগঠনগুলোকে বড় বড় রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি চর্চায় বাধ্য করা হয়। ছাত্রসংগঠনগুলো তাদের স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা হারিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অনুগত সংগঠনে পরিণত হয়। শুরু হয় অন্ধ লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ দুই সামরিক শাসকই তাঁদের ক্রীড়নক ছাত্রসংগঠনকে তাঁদের ক্ষমতা পাহারা দেওয়ার সশস্ত্র ক্যাডারে পরিণত করেন। শুরু হয় ছাত্ররাজনীতিতে সশস্ত্র হানাহানি। তাও আদর্শগত হানাহানি নয়, লাইসেন্স ও টেন্ডারবাজির হানাহানি। এই দূষিত পরিবেশ ছাত্রলীগেও সংক্রমিত হয়। সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পরও এই দূষিত পরিবেশ থেকে দেশের ছাত্ররাজনীতি মুক্ত হতে পারেনি।

পরগাছা ছাত্রদলগুলোর কথা বলছি না। দীর্ঘকাল বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করেছে ছাত্রলীগ। অন্য একটি শক্তিশালী ছাত্রসংগঠন ছিল বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সম্মিলিতভাবে ছয় দফা ও এগারো দফার আন্দোলন করেছে। স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতারা তো মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের ভূমিকাও নিয়েছেন। ছাত্র-জনতার প্রতিটি স্বার্থ ও অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল পুরোভাগে। স্বাধীনতা-উত্তর দেশ গঠনেও তার বড় ভূমিকা ছিল।

স্বাধীনতার পর এই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা থেকে ছাত্রলীগ সরে আসতে থাকে। স্বাধীনতার আগেই তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়। জাসদ-রাজনীতির অশুভ উত্থানে ছাত্রলীগেও ভাঙন ধরে।

প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসমাজে ভাঙন ধরার ফলে তার সুযোগ গ্রহণ করে জামায়াতের ছাত্রশিবির। তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শিক্ষাঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করে। হাত কাটা, রগ কাটার হিংসাত্মক রাজনীতি শুরু করে। ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার প্রসার ঘটায়। জামায়াতের শিবির ও বিএনপির ছাত্রদল মিলে দেশে অশুভ রাজনীতির সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। অনৈক্য জর্জরিত প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ তা রুখে দাঁড়াতে পারেনি।

স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পর আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর দেশে আবার গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা হয় এবং ছাত্রলীগও পুনর্গঠিত হয়। কিন্তু দীর্ঘকাল স্বৈরাচারী শাসনের আমলে সৃষ্ট দূষিত রাজনীতির প্রভাব ও পরিবেশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। দলের ভেতর অশুভ সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, স্বার্থান্ধ ও দুর্নীতিপরায়ণ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনা নিজেই ছাত্রলীগকে তার অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকায় ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং তার পেছনে ছাত্রলীগের ব্যাপক সাধারণ নেতাকর্মীর সমর্থন রয়েছে। তাই তারা ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব মনোনয়নের ভার নিঃসংকোচে তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারী শাসন উত্খাতের সংগ্রামে ছাত্রলীগের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, তাতে দলটিকে ফিরিয়ে নেওয়ার যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তাতে আমি আশান্বিত হয়েছি। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ দুটি সংগঠনেই একটা বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন এবং দুটি সংগঠন থেকেই ‘কাউয়ার দলের’ বিতাড়ন জরুরি প্রয়োজন। দেশকে হিংস্র মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে প্রগতিশীল ছাত্রসমাজকে আবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং দেশের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামতে হবে। এ ব্যাপারে ছাত্রলীগের এক বিশাল দায়িত্ব রয়েছে। ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত নেতৃত্ব সেই দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ হবেন এবং সেই দায়িত্ব পালনের জন্য বাস্তব ও কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করবেন—এটা আমার কেন, সারা দেশের মানুষের ঐকান্তিক আশা। (কালের কণ্ঠ থেকে সংগৃহীত)

লন্ডন, সোমবার, ১৪ মে ২০১৮

এই বিভাগের আরো সংবাদ