আজকের শিরোনাম :

ছাত্রলীগ : স্বদেশ গড়ার শপথে দীপ্ত আমাদের সংগ্রাম

  রনি মুহাম্মাদ

০৩ জানুয়ারি ২০২১, ২০:১২ | অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, পাকিস্তান সরকারের প্রথম বিরোধী দলীয় চিরযৌবনা এক সংগঠনের নাম। শৃঙ্খলার বেষ্টনী ভেঙ্গে সকল অর্জনের পিছনে সংগঠনটির যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি কাজে দিয়েছে তাহলো তারুণ্যের শক্তি। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তান নামে দুইটি দেশে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। এ বিভক্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি ভারত দ্বারা স্থল বেষ্টিত হওয়া সত্ত্বেও শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে হাজার মাইলের দূরত্বের পাকিস্তানের অংশ বিশেষ করা হল। যদিও ধর্ম ব্যতীত আর কোন কিছুতেই দুই ভূখণ্ডের কোন মিল ছিল না।

যখন বাংলাদেশ পাকিস্তানের উপনিবেশ হল তখন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করেছিলেন এ বিভাজন দ্বারা বাংলার মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আসবে না। এতে শুধু শাসকের পরিবর্তন হয়েছে শাসন ও শোষনতন্ত্রের কোন পরিবর্তন আসবে না। পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছিলেন ‘ফাঁকির স্বাধীনতা’ বলে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়ায় ‘এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে পড়া’র মতো।আগে শাসন-শোষন করত বৃটিশরা এখন করবে পাকিরা। শেখ মুজিব এও অনুধাবন করলেন যে এদের হাত থেকে বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হলে আন্দোলন, সংগ্রামের  বিকল্প কোন পথ নেই। আর আন্দোলন সংগ্রামের জন্য বেছে নিলেন তরুণ সমাজকে। তাই তিনি উদিয়মান সূর্যের ন্যায় তরুণ তুর্কি ছাত্র সমাজকে নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা করলেন একটি ছাত্র সংগঠন কালের পরিক্রমায় যার নাম আজ 'বাংলাদেশ ছাত্রলীগ'।

বিদ্যার সঙ্গে বিনয়, শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষা, জীবনের সঙ্গে দেশপ্রেম এবং মানবিক গুণাবলির সমন্বয় ঘটিয়ে শিক্ষা, শান্তি আর প্রগতির ঝাণ্ডা উড়িয়ে দীর্ঘ ৭ দশকের অধিক পথ চলায় এ সংগঠনের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহাসিক অর্জন। প্রতিষ্ঠার পরপরই সংগঠনটি রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে শাসকদের মুখোমুখি হয়। উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্রলীগের নেতারাই সর্বপ্রথম সম্মুখ প্রতিবাদ জানায়। ভাষার লড়াইয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ভাঙ্গা হয় ১৪৪ ধারা, প্রাণ বিলিয়ে দেন কয়েকজন। অসংখ্য নেতাকর্মী জেল জুলুমের শিকার হয়। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পেছনে ১৯৫৩ সালের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ের ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন অনুকরণীয় পেক্ষাপট হিসেবেও কাজ করে।

শুধু তাই নয় ঐ নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ের পেছনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সংগঠনটি যুগে যুগে যেমন ঐতিহাসিক অর্জনে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান তেমনি জন্ম দিয়েছে অসংখ্য বীর সেনানীদের। মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী ৪ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমেদ সবাই ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা। এছাড়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনাও ছিলেন রোকেয়া হল ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য। একটি কলেজের ভিপিও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে আওয়ামী লীগ ও সরকারে কাজ করে যাওয়া অধিকাংশ কর্তাব্যক্তিই ছাত্রলীগের সোনালী সূর্য সন্তান। সম্মুখের বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে নিপীড়িত দেশে আলোর সূর্য ছিনিয়ে এনেছে ছাত্রলীগ। আলোর সূর্য আনতে পার্থ প্রতীম, চুন্নু, মিজান,আসাদ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৭ হাজার নেতাকর্মীসহ অগণিত নেতা-কর্মী আত্মোৎসর্গ করেছেন।

সংগঠনটির জাতীয় অর্জনে যেমন রয়েছে ভূমিকা তেমনি ছাত্রদের অধিকার আদায়েও রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগের ভূমিকার বিষয়ে সবাই অবগত। ৬৬’র ৬ দফাকে ম্যাগনাকার্টায় অর্থাৎ বাঙালির মুক্তির সনদে পরিণত করার পেছনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। ৬ দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতারাও এর বিরোধিতা করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরোধিতার কারণে ৬ দফার পক্ষের প্রথম সভাটি ঢাকাতে না হয়ে চট্টগ্রামে হয়েছিল।

পরবর্তীতে ছাত্রলীগের নেতাদের তোপের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগের নেতারা ৬ দফার পক্ষে সমর্থন দিতে বাধ্য হন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৬ দফাকে তৃণমূল জনগণের কাছে পৌছে দেন ছাত্রলীগে নেতারা। ৬৮’র আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত করে এই ছাত্রলীগ। ১৯৭০ এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুস জয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন। একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। গৌরব, ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সাফল্যের দীর্ঘ পথচলায় ছাত্রলীগ  হারিয়েছে তার সহস্র্রাধিক নেতাকর্মীকে।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের সমাবেশে বলেছিলেন, ‘দানবের সঙ্গে লড়াইয়ে যে কোনো পরিণতিকে মাথা পেতে বরণের জন্য আমরা প্রস্তুত। ২৩ বছর রক্ত দিয়ে এসেছি। প্রয়োজনবোধে বুকের রক্তগঙ্গা বইয়ে দেব। তবু সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বাংলার শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করব না।’ তাই তো মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রাণের সংগঠনের ১৭ হাজার বীর যোদ্ধা তাদের বুকের তাজা রক্তে এঁকেছেন লাল-সবুজের পতাকা, এঁকেছেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এক সার্বভৌম মানচিত্র। সেসব বীর যোদ্ধাই আমাদের অনুপ্রেরণা, আমাদের শক্তি, আমাদের সাহস।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মীর মধ্যে আছে তরুণ মুজিবের নান্দনিকতা ও আদর্শ, আছে কাজী নজরুলের বাঁধ ভাঙার শৌর্য, আছে ক্ষুদিরামের প্রত্যয়, আছে সুকান্তের অবিচল চেতনা। তাই তো বাংলাদেশ ছাত্রলীগ শিক্ষার অধিকার রক্ষার পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থ সুরক্ষায় সবসময় মঙ্গলপ্রদীপের আলোকবর্তিকা হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চার দিগন্তে। ৭০ এর নির্বাচনে বাঙালির মুক্তির সনদ নিয়ে জনগণের দ্বারে উপস্থিত হয় এই ছাত্রলীগ। শুধু তাই নয় সংগঠনটি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া বলে এ সংগঠনের নেতা কর্মীদের প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস ও ভালবাসা। এ বিশ্বাসের ফলেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরে দেশের মাটিতে পা  রেখেই ছাত্রলীগকে দেশ গড়ার কাজে ঐক্যবদ্ধ করেন।

চলমান দুর্যোগে সংগঠনটি স্থাপন করেছে বিরল দৃষ্টান্ত। করোনা আতঙ্কে যেখানে সন্তান পিতা-মাতার লাশ রেখে পালিয়েছে, স্বামী স্ত্রীর লাশ ফেলে পালিয়েছে, স্ত্রী স্বামীর লাশ ফেলে পালিয়েছে সেখানে ছাত্রলীগ নেতা কর্মীরা টিম গঠন করে দলমত নির্বিশেষে সকলের লাশ দাফন করেছে। যেখানে বিএনপির নেতার মৃত্যুতে দলীয় নেতা কর্মীরা জানাজায় শরিক হওয়ার সাহস দেখায়নি সেখানে ছাত্রলীগের নেতারা গিয়ে লাশ দাফন করেছে। অন্নহীনের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের পাশে মানসিক ও আর্থিক সাহায্য নিয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ বান্দরবান জেলা ছাত্রলীগ আর্থিক সংকটাপন্ন মুমূর্ষু রোগীদের বহনের জন্য ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস চালু করে গেয়েছে, ‘আমরা তো আছি ভয় কি বন্ধু জেগে ওঠো পদাতিক।’

কোন দুর্যোগকে মোকাবেলা করতে হলে দলমত নির্বিশেষে সকলকে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার বিকল্প নেই। ছাত্রলীগ সেটি প্রমাণিত করেছে।এ দেশের মানুষ অন্য কোন ছাত্র সংগঠনকে পাশে না পেলেও ছাত্রলীগকে ঠিকই পাশে পেয়েছে। করোনাকালীন দুর্যোগে সাধারণ মানুষের হৃদয় কেড়ে নিয়েছে ছাত্রদের এ সংগঠনটি। ছাত্রলীগের এমন বীরোচিত ঘটনা এবারই প্রথম তেমনটি নয়। অতীতেও সকল দুর্যোগ মোকাবেলায় সংগঠনটির কর্মীরা ছিল প্রথম সারির যোদ্ধা।  ৮৮ র বন্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে তিনবেলা রুটি এবং রাত জেগে খাবার স্যালাইন বানিয়ে তৃণমূল মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছিল। ৯৮ র বন্যাতেও ছিল একই ভূমিকা।

এছাড়াও স্বৈরচার বিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধী বিচারের আন্দোলনে জনগণের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সংগঠনটি দিয়েছে নেতৃত্ব। ছাত্রলীগ যৌক্তিক দাবিতে অনড়। অনড় বলেই ১৯৯৮ সালে বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে ছাত্রলীগ তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলে। সামসুন নাহার হলে ছাত্রদলের ক্যাডারদের নিয়ে রাতের অন্ধকারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ হামলা করলে তার বিচারের দাবিতে ছাত্রলীগ আন্দোলন গড়ে তুলে। ছাত্র সমাজের অধিকার আদায়ে এবং গণমুখী আন্দোলনে প্রিয় এ সংগঠনটি তার চলার পথ অব্যাহত রাখবে বলে আশা রাখি। নবীনদের মেধা দেশ গড়ার কাজে লাগুক, স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে বিধৌত হোক নতুন প্রজন্মের বিবেক ও চেতনা। অনাগত প্রজন্মের লড়াই হোক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে, সব অশুভ শক্তিকে পেছনে ফেলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রেখে, দেশগড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ‘সারা স্বদেশের আন্দোলনের মৃত্যুঞ্জয়ী নাম, স্বদেশ গড়ার শপথে দীপ্ত আমাদের সংগ্রাম’। আজ ৪ জানুয়ারি সেই সংগ্রামের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দেশবাসীকে জানাই শুভেচ্ছা।

লেখক: কেন্দ্রীয় নেতা, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।


এবিএন/জসিম/তোহা

এই বিভাগের আরো সংবাদ