‘এমন নেতা কোথায়, যিনি ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্প্রীতি রাখবেন?’
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০১৮, ১২:১৬
অনমিত্র সেনগুপ্ত, ১৮ আগস্ট, এবিনিউজ : রাজধানীর রাস্তা বেয়ে এগোচ্ছে সেনাবাহিনীর কামানবাহী শকট। তার উপরে রাখা কফিনে শায়িত অটলবিহারী বাজপেয়ীর নশ্বর দেহ। পথে পড়ল এক মাদ্রাসা।
মৌলানা সাহেব তাঁর পড়ুয়াদের হাতে গুঁজে দিয়েছেন গোলাপের পাপড়ি। চোখে জল। স্লোগান উঠছে, ‘‘যব তক সুরজ চাঁদ রহেগা, অটল তেরা নাম রহেগা।’’ মহম্মদ ইউসুফ বলছেন, ‘‘এমন নেতা আজ কোথায়, যিনি ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্প্রীতি রাখবেন?’’ একটু দূরেই সঙ্ঘের পোশাক পরিহিত এক দল কর্মী। আওয়াজ উঠল, ‘‘জয় শ্রীরাম।’’
মৃত্যুতেও মেলালেন বাজপেয়ী। ১৯৯১-এর পরে ২০১৮। দীর্ঘ সাতাশ বছর পরে আবার কোনও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানাতে পথে নামল আমজনতা।
প্রায় তিন দশক আগে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন রাজীব গাঁধী। স্রেফ দূরদর্শন-নির্ভর সেই জমানায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে শেষ বার চোখের দেখা দেখতে চেয়েছিল মানুষ। সে দিন তাই অঘোষিত বন্ধের চেহারা নিয়েছিল গোটা রাজধানী। স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল, এমনকি দোকান-বাজারও ঝাঁপ খোলেনি। বন্ধ ছিল গণপরিবহণ। কিন্তু আজ প্রতি মুহূর্তে উপগ্রহ চ্যানেলের ‘লাইভ’-এর যুগেও সেই অতীতের মতোই রাজপথে জনজোয়ার দেখল দিল্লি। রাজনৈতিক মহলে ‘অজাতশত্রু’ বাজপেয়ীর শেষযাত্রায়।
গতকাল মৃত্যুসংবাদ ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই ভিড় বাড়ছিল কৃষ্ণ মেনন মার্গের বাড়ির সামনে। রাত দশটার পর থেকেই বাড়ির দরজা খুলে দেওয়া হয় জনতার জন্য। রাতভর লোক আসে দিল্লি ও রাজধানীর আশপাশের এলাকা থেকে। ঠিক ছিল, আজ সকাল ৯টায় বাজপেয়ীর বাসভবন থেকে মরদেহ যাবে দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে, বিজেপির সদর দফতরে। কিন্তু ভিড়ের জন্য অন্তিম যাত্রা শুরু হতে হতে প্রায় ১০টা বেজে যায়।
জীবদ্দশায় দলের নতুন দফতরে যাওয়াই হল না বাজপেয়ীর। আজ তাঁর দেহ আসবে বলে ভিড় জমছিল সেখানেও। কিন্তু অনেকেই ভিতরে ঢোকার ছাড়পত্র পাননি। যেমন মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা কান্তাবাই। রাস্তায় মোতায়েন পুলিশদের ধরে কাঁদতে কাঁদতে কাকুতি-মিনতি করছিলেন, ‘‘একটি বার দেখতে দিন। মনের শান্তি হোক।’’ কিন্তু ভিতরে তখন প্রধানমন্ত্রী, অন্য মন্ত্রীরা, ভুটানের রাজা। অগত্যা রাস্তার পাশে অটলের পোস্টারেই সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন কান্তাবাই।
ঘণ্টা দুয়েক বিজেপি দফতরে থাকার পরে শেষযাত্রা বেরোল অন্ত্যেষ্টির পথে। কামানবাহী শকটের পিছনে হাঁটছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহেরা। কৃষ্ণ মেনন মার্গ, ইন্ডিয়া গেটের ‘হেক্সাগন’, তিলক মার্গের দু’ধারে তীব্র রোদ উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে বহু মানুষ। কানায় কানায় ভরা আবাসনের ছাদগুলো। হাতে হাতে মোবাইল। আজও দিল্লির বহু জায়গায় বন্ধ ছিল দোকান-বাজার, স্কুল-কলেজ। সরকারি কর্মীরা যাতে বাজপেয়ীকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পান, দুপুরের পরেই ছুটি হয়ে যায় সরকারি দফতর, সুপ্রিম কোর্ট।
কালই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিদায় জানানো হবে বাজপেয়ীকে। দায়িত্ব দেওয়া হয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ‘সেরিমোনিয়াল’ শাখাকে। ঠিক হয়, মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে ‘গান ক্যারেজ’ বা কামানবাহী গাড়িতে। মন্ত্রক জানিয়েছে, স্বাধীন ভারতে গাঁধীজির মৃত্যুর পরে প্রথম বার কারও শেষযাত্রায় কামানবাহী গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। আর বিশেষজ্ঞদের মতে, গোটা বিশ্বে সম্ভবত প্রথম বার এ ভাবে গান ক্যারেজ ব্যবহার হয় রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর সময়ে।
শেষকৃত্যের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল যমুনার তীরে রাষ্ট্রীয় স্মৃতিস্থলকে। গোটা এলাকাই ঘেরা হয়েছিল তেরঙ্গা পতাকার রঙে। বিকেল ৪টে ৫০ মিনিটে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী, বিদেশি অতিথিদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষ হলে শবাধারের উপরে রাখা জাতীয় পতাকা রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ভাঁজ করে তুলে দেওয়া হয় বাজপেয়ীর নাতনি নীহারিকার হাতে। পাঁচটা বাজতে ঠিক চার মিনিট বাকি। জলভরা চোখে বাবার মুখাগ্নি করলেন নমিতা ভট্টাচার্য। গর্জে উঠল গোর্খা রেজিমেন্টের জওয়ানদের রাইফেল। পরপর তিন বার। সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল বৃষ্টি। গান স্যালুটের আওয়াজ মিশে গেল মেঘের গর্জনে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নির্দেশ দিয়েছেন, তাঁর রাজ্যের ৭৫টি জেলায় গঙ্গা-যমুনা-সহ সব নদীতে ভাসানো হবে বাজপেয়ীর অস্থি। গ্বালিয়র অটলের জন্মভূমি। সূত্র বলছে, মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান স্থির করে ফেলেছেন, সামনের ভোটে বাজপেয়ীই তাঁর তাস।
ভোটের আগে অটল-আবেগকে আগাগোড়া আঁকড়ে রইলেন মোদীও। আপাতত ঠিক রয়েছে, ১৯ তারিখে হরিদ্বারে অস্থি বিসর্জনে উপস্থিত থাকতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। (আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে নেয়া)
এই বিভাগের আরো সংবাদ