আজকের শিরোনাম :

সড়ক আন্দোলন, প্রশাসন চনমন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০১৮, ২১:৪৮

খন রঞ্জন রায়, ১০ আগস্ট, এবিনিউজ : এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, সড়ক দুর্ঘটনা কিছুতেই কমছে না, বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। অবস্থা ‘মহামারী’ আকার ধারণ করেছে। একটি ঘটনার রেশ না কাটতেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দুর্ঘটনার খবর থাকছে। এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও অনেক। গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২৫ হাজার ১২০ জন। প্রতিদিন ২০ জন। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৬২ হাজার ৪৮২ জন। এসব দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশ ঘটেছে চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও অতিরিক্ত গতির কারণে।

এসব সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। এই দুই শ্রেণিকে দেশের ভবিষ্যৎ ও অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির আর্থক পরিমাণ বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এটি সরকারি হিসাব, বেসরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০১৭ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৭ হাজার ৩৯৭ জন। এর বাইরে নিরাপদ সড়ক চাই ‘নিসচার’ হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৫ হাজার ৬৪৫ জন। প্রতিদিন দেশের কোন না কোন প্রান্তে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। আহত ও নিহত হচ্ছে যাত্রী-পথচারী এর মধ্যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট শহীদ রমিজউদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী মীম ও রাজীবের দুর্ঘটনা দাগ কেটেছে জাতীয় জীবনে।

গত ১লা আগস্ট (বুধবার) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস অন্য দিকে বাসের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অপেক্ষমান যাত্রীদের ওপর তুলে দেয়। এতে ঘটনাস্থলে ক্যান্টনমেন্টের শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী মীম ও রাজীব নিহত হয়। আহত হয় ১১ শিক্ষার্থী। এতে ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মীম-রাজীব নিহত হওয়ার ঘটনা মেনে নিতে পারেনি তারা। ওই দিনই তারা রাস্তায় নামে। শান্তিপূর্ণভাবে সড়কে হত্যার প্রতিবাদ জানায়। রাস্তায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা কিছু বাস ভাঙচুর করলেও অন্য কোনো যানবাহনের ওপর আঘাত করেনি। চলাচলে বাধা দেয়নি। তবে যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না, তাদের চলতে দেয়নি। অ্যাম্বুল্যান্সসহ কোনো কোনো গাড়ি দ্রুত চলাচলে সাহায্য করেছে। কোথাও কোথাও রাস্তায় পড়ে থাকা গাড়ির ভাঙাচোরা গ্লাস পরিস্কার করেছে। ট্রাফিক পুলিশের কাজ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে।

নতুনধারার এই প্রতিবাদের প্রতি শুধু অভিভাবকরা নন, সাধারণ মানুষও সমর্থন জানিয়েছে। প্রতিবাদ-আন্দোলনের কারণে রাস্তায় চলাচলে বিঘœ ঘটলেও নগরবাসী অসন্তুষ্ট হয়নি। গণমাধ্যমও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেনি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছেন একজন মন্ত্রী। মন্ত্রী মহোদয়ের প্রতিক্রিয়াটি ছিল অত্যন্ত বিচিত্র। তিনি কয়েক দিন আগে ভারতবর্ষে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে সবাইকে (হাসিমুখে) জানিয়েছেন, তারা যদি সেই ঘটনাটি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে, আমরা কেন সেটি নিয়ে এত ব্যস্ত হয়েছি। যে সহজ বিষয়টি তাঁর নজর এড়িয়ে গেছে সেটি হচ্ছে ভারতবর্ষের ঘটনাটি ছিল একটি দুর্ঘটনা, আমাদের ঘটনাটি দুর্ঘটনা নয়, সেটি এক ধরনের হত্যাকা-। একটুখানি দায়িত্বশীল হলেই এই ঘটনা ঘটত না।

এরই প্রতিবাদেই সারাদেশের স্কুল শিক্ষার্থী তরুণ প্রজন্ম প্রতিবাদ করছে। তারা স্কুল কলেজ ছেড়ে রাস্তায় নেমেছে। তাদের প্রশ্ন এইসব ঘটনা দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকা-। রাস্তায় নামা তরুণসমাজের এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তারা পিটিয়ে, মামলা দিয়ে, অনুপ্রবেশকারী দিয়ে নাশকতা করে, স্কুল বন্ধ রেখে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে, তাদের নামে অপবাদ দিয়ে হয়তো এবারও পার পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের বুকের ধিকিধিকি আগুন নিভবে না তাতে। এই আগুন শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই ছাত্রের মৃত্যুতে এক দিনে তৈরি হয়নি। এটি তৈরি হয়েছে বহু বছর ধরে রাজপথে বেপরোয়া হত্যাযজ্ঞে, এর কোনো বিচার না পেয়ে, এই হত্যাকারীদের দিয়ে পরিবহন ব্যবসা চালানো সরকারি লোকজনের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেখে দেখে।

দেশের এই বিপুলসংখ্যক তরুণই আমাদের আগামী, আমাদের ভবিষ্যৎ। সব ভয়কে জয় করে তারা একসঙ্গে প্রতিবাদ করেছে। সেই সঙ্গে রাজপথে তৈরি করেছে কিছু অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য। চাইলেই ভুয়া লাইসেন্স ধরা যায়, উল্টো পথের গাড়ি ফেরানো যায়, সড়কে শৃঙ্খলা আনা যায়- আমাদের বুড়োদের অসামান্যভাবেই তা করে দেখিয়েছে কিশোর-তরুণেরা। এক অভূতপূর্ব অবিশ্বাস্য দৃশ্য। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাস, মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল পরীক্ষা করছে। যেসব যানবাহনের চালক গাড়ির ফিটনেস সনদ, হালনাগাদ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে পারেননি, তারা সেসব যানবাহন থামিয়েছে। পুলিশ ডেকে মামলা নেওয়ার ব্যবস্থা করছে। গাড়ির ফিটনেস কিংবা চালকের হালনাগাদ লাইসেন্স না থাকা যানবাহন থেকে মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় কর্তা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জ্যেষ্ঠ সদস্য ও গণমাধ্যমের কর্মীদেরও নেমে যেতে বাধ্য করছে তারা।

এই কিশোর-তরুণেরা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কীভাবে সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হয়, কীভাবে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে হয়। পূর্বসূরিরা অন্ধ হলে উত্তরসূরিরাই পথ দেখায়। রাস্তায় যে কাজটি ট্রাফিক পুলিশকে করার কথা, বিআরটিএর করার কথা, সেই কাজটি করল কিশোর-তরুণেরা। একটি শহরের বিশৃঙ্খলা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে মুহুর্তের মধ্যেই নিয়মতান্ত্রিক অবস্থায় নিয়ে এসে তরুণরা যা করেছে, তা সত্যি বিস্ময়। এ বিস্ময় অপার। এ সম্ভাবনা শেষ হওয়ার নয়। সারা বছর যে রাস্তায় যানজট লেগে থাকত, রিক্সার জটের কারণে হাঁটা যেত না, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালাত সবাই, তা বন্ধ করে দিয়েছে এ তরুণরা।

যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান- এর শিরোনাম ছিল, দুর্ঘটনার প্রতিবাদে কিশোরদের বিক্ষোভে বাংলাদেশের অংশবিশেষ অচল। ‘বাংলাদেশ প্রাণঘাতী সড়ক দুর্ঘটনার পর ব্যাপক ছাত্রবিক্ষোভ’ শিরোনামে খবর প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক আল-জাজিরা। খবরে বলা হয়, এভাবে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর রাস্তায় নেমে আসার ঘটনা নজিরবিহীন। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভ সরকারকে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।

এই ছাত্র আন্দোলনটি অসাধারণ! অতুলনীয়! এমন দৃশ্য কেউ আগে কখনো দেখেনি, চিন্তাও করেনি। বিশ্বের আর কোনো দেশে এমনটি ঘটেছে কি না তাও আমাদের জানা নেই। নিরাপদ সড়কের দাবীতে একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে সাধারণজনের শক্তির উদ্বোধন আমরা প্রথম প্রত্যক্ষ করি। আমরা যারা আশাবাদী মানুষ, তারা সব ধরনের প্রতিকূলতা সহ্য করেই এ দেশে আছি এবং থাকব। আমরা কখনো হতাশায় ভুগিনি। আমরা সব সময়ই স্বপ্ন দেখি এই দেশ নিয়ে। সব সময় বলি, অবশ্যই একদিন বাংলাদেশ সোনার বাংলা হবে। সেই অপেক্ষায় দিন গুণছি। আমাদের প্রজন্ম না হলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সোনার বাংলা গড়ে তুলবে। এ আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের আছে। তারই বারতা দিল আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।

‘যদি তুমি ভয় পাও
তবে তুমি শেষ,
যদি তুমি রুখে দাঁড়াও
তবে তুমি বাংলাদেশ’।

এ মুল্যবান লাইনগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরছে। সাধারণ থেকে শুরু করে জনপ্রিয় ব্যক্তিরাও এ লাইনগুলো শেয়ার করছেন। লাইনগুলো এ সময়ের তরুণদের ভাবনা থেকে এসেছে। যে তরুণরা ১৮ বছর বয়সের দৃপ্ত-প্রদীপ্ত, তারা এ আধুনিক সময়ে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছে মেধা ও মননে। এ সময়ের তরুণরা অসম্ভব মেধাবী, তাদের অবজ্ঞা-অবহেলা করার কোনো সুযোগই নেই। যুক্তিনির্ভর তরুণরা কোনো ধরনের প্রহসনকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। কারণ তাদের কাছে হাতের মুঠোয় গোটা বিশ্ব।

নতুন গাড়ির লাইসেন্স প্রদান, পুরাতন গাড়ীর লাইসেন্স নবায়ন, গাড়ির ফিটনেস, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন জাতীয়ভাবে করে থাকে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি এর প্রধান কার্যলয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের খুব কাছাকাছি বেগুনবাড়িতে। বিআরটিএ, রাজধানী শহর ঢাকা, বিভাগীয় ও জেলা শহরে নিজস্ব কার্য্যলয় আছে। ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল বাংলাদেশের এক গবেষণামূলক জরিপে দেখতে প্রায় বিআরটিএতে কর্মরত ২৭ হাজার ৮১৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োজিত। তাদের কারোর গাড়ি তৈরি, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রাইভিং শিক্ষায় ডিপ্লোমা বা কোন প্রকার প্রশিক্ষণ নেই।

এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ। ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ড্রাইভিং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনালজি ও গাড়ি তৈরি বিষয়ে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনোলজি এর সুষ্পষ্ট সমাধান দিতে সক্ষম। প্রতিটি উপজেলায় সরকারি-বেসরকারিভাবে একাধিক ইনস্টিটিউট অব ড্রাইভিং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি প্রতিষ্ঠা। এই কাজটি সহজ সরল সমাধান খুজঁতে পারে একমাত্র বিভাগয়ি ডিপ্লোমা শিক্ষা বোর্ড।

লেখক : মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিক্ষা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ

এই বিভাগের আরো সংবাদ