ধর্ষণ : এক বিকারগ্রস্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি
ফাহমিদা হক
২৭ অক্টোবর ২০২০, ১৯:০৫ | অনলাইন সংস্করণ
একের পর এক ঘটছে ধর্ষণের মতো ঘটনা। একটার চেয়ে ভয়াবহ আরেকটা| ধর্ষণের মতো অপরাধ থামানো তো যাচ্ছেইনা বরং বেড়েই চলছে। আর লাগামহীন এসব দেখে দেখে একদল আহা!, উহু করছে।আরেক দল গলা উচিয়ে বলছে- পর্দা না করলে তো রেপ হবেই, মানে হচ্ছে রেপ কোন অপরাধ না। যদি কেউ পর্দা না করে তো রেপ সে হতেই পারে। ধর্ষককে আকৃষ্ট করা যাবে না কোন ভাবে। অপরাধ কিন্তু ধর্ষকের নয় সব দোষ যেন ঐ পর্দা না করা শিশু বাচ্চার। হোক সে ছেলে বা মেয়ে। হোক ৮০ বছরের বৃদ্ধা বা রাস্তার পাগলী নারী কিংবা নিজ ঘরে বাচ্চাদের পাশে থাকা অসহায় বধু। যুক্তির কাছে নাস্তানাবুধ হয়ে অসহায়ভাবে বাকরুদ্ধ পুরো সমাজ। সাক্ষীর অভাবে আইনের ফাঁক গলিয়ে বেড়িয়ে আসে ধর্ষক।
সারাদেশ জুড়ে যখন ধর্ষকের শাস্তি নিয়ে মানুষ সরব হচ্ছে, একদল মানবাধিকারের বয়ান নিয়ে হাজির। তারা বলছেন মৃত্যুদন্ড দিয়ে সাজা দেয়া মানবাধিকারের লঙ্গন। আচ্ছা মানবাধিকার তো মানুষের জন্যে, মানুষের দ্বারা তৈরি আধিকার আইন যা মানুষ নামে বিবেচিত হলে তবেই তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়া উচিত।কোন পিশাচ বা প্রমানিত ধর্ষকদের জন্যে নিশ্চই নয়!
কিছুদিন আগে দেখলাম, সরকারী টেলিভিশন বিটিভিতে এক ভদ্র মহিলার উপস্হাপনায় আলোচনা অনুষ্ঠান চলছে, যেখানে আলোচনার বিষয় হচ্ছে ধর্ষণ । সেই শো’তে আলোচকদের একজন ধর্মীয় মূল্যবোধের কথা বলছেন। সকল ধর্মেই মূলত মানুষের কল্যানের কথা বলা আছে। পারস্পরিক মূল্যবোধ, বিবেক মানুষকে পশুত্ব থেকে মানুষে আলাদা করে, যা মানুষ পারিবারিক, ধর্মীয়, সামাজিক সকল ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে নিজেকে মানবিক মানুষ হিসেবে পরিচিত করাতে পারে। মানবিকমূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ কখনো জোড় জবরধ্বস্তি করে ধর্ষণ বা যৌন হয়রানীমূলক অপরাধ বা পিশাচের আচরণ করতে পারে না। যে কোন মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী না থাকলেও কেবল মনুষত্বগুণের কারণেই অমর হয়ে থাকে। এখানে মনস্তত্ত্বিক গুণ অর্জন করাটাই মূখ্য।
আলোচনার টেবিলে সাবেক এক পুলিশ অফিসার বলছেন, “ছেলেদের মধ্যে ঢুকাই দিতে হবে, নারীর প্রতি সম্মানের কথা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুলাঙ্গারগুলারে মনের মধ্যে নারীকে সম্মান দেয়ার কথা ঢুকায়ে দিতে হবে। তোমার মা, বোনও নারী এটাও ঢুকায়ে দিতে হবে। তোমাদের মা বোনের সাথে করলে কেমন লাগবে এসবই ঢুকায়ে দিতে হবে।”
এরপর আলোচনার বিষয় ছিলো, ধর্ষণ দেশে দেশে হচ্ছে।বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে তিনি বলছেন, বাংলাদেশে সেই তুলনায় ধর্ষণ কম, হাজারে মাত্র ৮ নারী। এখন বলেন তো, এই পুলিশ অফিসারের মাথার ভিতরেও কি ঢুকায়ে দিতে হবে যে, কেবল নারীই ধর্ষিত হচ্ছে না দেশে। এদেশে শিশুবাচ্চা নাবালক ছেলে, বা মেয়েও ধর্ষিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত । আমার কাছে সবচেয়ে খারাপ লাগার বিষয় ছিলো , কোথাও ধর্ষণ প্রমানিত হলে ধর্ষকের কি শাস্তি হওয়া উচিত তার কথা কেউ একটিবার বলেনি। পুলিশ অফিসার অকপটেই বলেছেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে বেশীরভাগ আসামী কেবল ধর্ষণের সাক্ষীর অভাবে মুক্তি পেয়ে যান আর মামলা ডিসমিস হয়ে যায়। মূল কথা হচ্ছে ধর্ষণ নিয়ে জাতবাজী করা বজ্জাতরা এমন অন্যায় নিজেরা করে এবং অন্যায়কে জায়েজ করার ফতোয়া দিয়ে অপরাধীকে বাঁচিয়ে রাখে।
২০০৮ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৩০৭ জন আর ২০১৯ -এ ধর্ষণের শিকার হন ১৪১৩জন। আর ২০২০ -এর এই কয়মাসেই ধর্ষণের শিকার হন প্রায় ৩ গুন। এসব ধর্ষণের শিকার কেবল নারী বা মেয়ে শিশুরাই হচ্ছে না। ছেলেশিশুরাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ব্যাপক হারে। ৫৬ বছরের রংপুরের বাদশা মিয়া ৪ বছরের ছেলে বাচ্চাকে তার শিকারে পরিনত করে।চট্টগ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষক নাছির উদ্দিন প্রতিনিয়ত শিশুবাচ্চাদের উপর অমানবিক এমন কাজ চালিয়েছেন দীর্ঘদিন। এমন ধর্ষণের ঘটনা প্রতিদিনই আমরা কোথাও না কোথাও দেখতে বা শুনতে পাচ্ছি। সব ধর্ষণের ঘটনা খবর হয় না। তারপরেও পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে অবক্ষয়ের ভয়াবহ চিত্রই দেখতে পাই।আইন সালিশ কেন্দ্র সাতক্ষীরা ও ঢাকার ৯ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে জরিপ করে দেখতে পেয়েছে, প্রতি ১০ জনে একজন শিশু ধর্ষণের শিকার। শিশুরা সবচেয়ে অনিরাপদ তার পরিবার, চারপাশ এবং নিকটজনদের কাছে। শিশুরা সবচেয়ে বেশী ধর্ষণের শিকার হয় তার পরিচিতজনদের দ্বারা যা তারা সবসময় প্রকাশ করতে পারে না। ১৬ বছরের নীচে সকল শিশুকে নাবালক হিসেব ধরা হয়। এই বয়সে বাচ্চারা এমন পরিস্হিতির শিকার হয়ে ট্রমাটাইজ হয়ে যায়। যার ধকল বাকী সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয় শিশুটিকে। একটা শিশু যখন ধর্ষণের মতো ভয়াবহ পরিস্হিতির শিকার হয়, বেশীর ভাগ সময় তারা বুঝেও না এর ভয়াবহ পরিণতির কথা। এসব ক্ষেত্রে পরিবারের বড়দের সর্বদা সতর্ক থাকা উচিত। শিশুদের বুঝিয়ে বলা দরকার যেন কোনরকম খারাপ স্পর্শ তাদের উপর না আসতে পারে। সকল তথ্য উপাত্ত বলছে , শিশুরা সবচেয়ে বেশী যৌন হয়রানীর শিকার হয় নিকটজনদের দ্বারা| প্রতিটি বাবা মাকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যেখানে ছেলে বা মেয়ে বলে আলাদা চিন্তা করে ভুল করা যাবে না। সকল বয়সের বাচ্চা (ছেলে, মেয়ে) এই বর্বরতার শিকার হচ্ছে এখন।
বর্তমান সময়ে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে সর্বত্র ঘটছে ধর্ষণ। সামাজের উঁচু তলা থেকে ফুটপাত পর্যন্ত বিস্তার এই যৌন অবক্ষয়ের। পোষাকের দায় দিয়ে ধর্ষকদের প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। পোষাক হলো ব্যক্তিগত রুচির বিষয় যার বিচারের ভার কেবল ব্যক্তির নিজের। আর ধর্ষণ হলো মস্তিষ্ক বিকৃত অমানবিকতা যা সে অন্যের উপর করে থাকে। ধর্ষকের বিকৃত মস্তিষ্ক কারো পোষাক, জাত, শ্রেণী বা লিঙ্গ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়। অন্যের ঘরে ঢুকে হাসতে হাসতে নারীকে উলঙ্গ করে, ক্যামেরা অন করে রেপ করে আবার সেই রেপের ভিডিও ফেসবুকে আপলোড দেয়া কোন সুস্হ্য মস্তিষ্কের মানুষের কাজ হতে পারে না।আপন ছেলেমেয়ের সামনে কোন নারীকে বেঁধে ধর্ষণ করাই প্রমান করে, ক্ষমতাকে অন্ধভাবে ব্যবহার করার মতো পৈশাচিকতা সম্পন্ন মগজ কোনভাবেই নারীর পোষাকের শালীনতার ধার ধারে না। শরীর সর্বস্ব মস্তিষ্ক এদের, এরা পোষাক দেখে না, শিশু বুঝে না, নারী চিনে না। এদের বিবেক কাজ করে না, এরা কেবলই বিকৃত, এরা মানুষ নয়, ধর্ষক।
অসহায় দুর্বলের উপর যৌন হয়রানী করা যতটা সহজ ততটা সহজ নয় সবল সচেতন কোন শিশু বা নারীর উপর যৌন অত্যাচার করা। সমাজের সবচেয়ে দূর্বল অসহায় নারী, শিশুরাই বেশী যৌন হয়রানীর শিকার হয়। কারণ প্রতিবাদ করার ক্ষমতা যেখানে কম অত্যাচারের মাত্রা সেখানেই বেশী। এক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্হা যত স্বচ্ছ হবে, সুষ্ঠ হবে, আইনের হাত যত কঠোর হবে নির্যাতন কারী তত ভয় পাবে। বিচার যদি দ্রুত এবং কঠিনভাবে কার্যকর করা হয় তবে অবশ্যই যৌন নির্যাতন কমে আসবে।যেমনিভাবে কমেছে এসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা। প্রমানিত কোন ধর্ষককে মানবতা দিয়ে বিচার করার কিছু নেই। ধর্ষককে ধর্ষণের সাজা পেতেই হবে। আইনের কোন অলি গলিতে ধর্ষকেরা প্রবেশ না পেলে ধর্ষণ ধীরে ধীরে হলেও কমবে। সবশেষে বলতে চাই ধর্ষণের মাত্রা কমাতে হলে সবার এক হয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার অবস্হান থেকে সজাগ সচেতন সতর্ক থেকেই যৌন হয়রানী রুখে দেয়া সম্ভব। লেখক: নিউ মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর, সিজিএস এবং পরিচালক, সিসিএন *** বি: দ্র: প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। ***
অসহায় দুর্বলের উপর যৌন হয়রানী করা যতটা সহজ ততটা সহজ নয় সবল সচেতন কোন শিশু বা নারীর উপর যৌন অত্যাচার করা। সমাজের সবচেয়ে দূর্বল অসহায় নারী, শিশুরাই বেশী যৌন হয়রানীর শিকার হয়। কারণ প্রতিবাদ করার ক্ষমতা যেখানে কম অত্যাচারের মাত্রা সেখানেই বেশী। এক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্হা যত স্বচ্ছ হবে, সুষ্ঠ হবে, আইনের হাত যত কঠোর হবে নির্যাতন কারী তত ভয় পাবে। বিচার যদি দ্রুত এবং কঠিনভাবে কার্যকর করা হয় তবে অবশ্যই যৌন নির্যাতন কমে আসবে।যেমনিভাবে কমেছে এসিড নিক্ষেপের মতো ঘটনা। প্রমানিত কোন ধর্ষককে মানবতা দিয়ে বিচার করার কিছু নেই। ধর্ষককে ধর্ষণের সাজা পেতেই হবে। আইনের কোন অলি গলিতে ধর্ষকেরা প্রবেশ না পেলে ধর্ষণ ধীরে ধীরে হলেও কমবে। সবশেষে বলতে চাই ধর্ষণের মাত্রা কমাতে হলে সবার এক হয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র যার যার অবস্হান থেকে সজাগ সচেতন সতর্ক থেকেই যৌন হয়রানী রুখে দেয়া সম্ভব। লেখক: নিউ মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর, সিজিএস এবং পরিচালক, সিসিএন *** বি: দ্র: প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। ***
এই বিভাগের আরো সংবাদ