আজকের শিরোনাম :

বাংলাদেশের প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুননেসা 

  মুহাম্মদ হিলালউদ্দীন

২৪ অক্টোবর ২০২০, ১১:৩৯ | অনলাইন সংস্করণ

অবিশ্বাস্য পৈশাচিকতার শিকারে পরিণত হবার সময় মানুষটি'র বয়স ছিল মাত্র ২৯, জীবনের সূচনাতেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল মা ও ভাই'দের নিয়ে। জীবন সংগ্রামে তিনি জয়ীই ছিলেন, সে যুদ্ধে তিনি অপরাজেয়। বাবা'র মৃত্যু'র পর পুরো সংসারের দায়িত্ব তাঁর ওপরেই এসেছিল।

১৪ বছর বয়সে, প্রজাপতির মতো জীবন হবার কথা যার। তাঁকে মুখোমুখি হতে হয় কঠিন জীবন যুদ্ধে। বাংলা একাডেমী, ইউসিস লাইব্রেরী'তে কপি রাইটার হিসেবে কঠোর শ্রম দিয়েছেন। সবকিছু ছাপিয়ে তিনি এক অনন্য দেশপ্রেমিক, স্বজাত্যবোধে অনুপ্রাণিত এক মহান মানুষ। তাঁর নাম মেহেরুননেসা।

বাংলাদেশের প্রথম নারী শহীদ কবি মেহেরুননেসা।

১৯৪২ সালের ২০ আগস্ট জন্মেছিলেন কোলকাতার খিদিরপুরে। শৈশব কেটেছে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে। ছোটবেলা থেকেই যেন পৃথিবীর প্রতি আগ্রহ প্রবল ছিল তাঁর। তাই বাবার সঙ্গে ছোট্ট মেয়েটি কয়লার দোকানে বসতেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দাঙ্গায় উদ্বাস্তু হয়ে মেহেরুনদের পরিবার ১৯৫০ সালে ঢাকা চলে আসেন। পুরান ঢাকার নানান এলাকায় বাস করে ১৯৬৫ সালে তাঁদের পরিবার থিতু হয়ছিলেন মিরপুরে। সেসময় মিরপুর বিহারী অধ্যুষিত এলাকা, বাঙালী পরিবার বিহারীদের তুলনায় নগণ্য।

আমাদের অনেকেরই জানা নেই, 'আমাদের দাবী মানতে হবে' এবং 'রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই' শ্লোগান দুটি কবি মেহেরুননেসার সৃষ্টি। ১৯৫৪ সালে তাঁর রচিত কবিতা 'রাজবন্দী'তে এ লাইন দুটি এসেছে।

বাবা'কে হারিয়েছিলেন ক্যান্সারে। এরপর, জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে তিনি ফিলিপস ওয়ার্কশপে রেডিও মেরামতের কাজও করেছেন।এখানে অবশ্য উল্লেখ্য যে, সে সময় ফিলিপস ইংরেজি ও উর্দু'তে মুখপত্র ছাপাতো, কবি মেহেরুননেসা'র চেষ্টায় বাংলা ভাষায় রচিত পত্রিকাও প্রকাশে বাধ্য হয়েছিল ফিলিপস কর্তৃপক্ষ।

কবিতার প্রতি ভালোবাসা, বাংলা সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম আকর্ষণ তাঁকে সাহিত্য চর্চা থেকে দূরে থাকতে দেয়নি। তাঁর সৃষ্টি ছাপা হয়েছে, ইত্তেফাক, বেগম, দৈনিক পাকিস্তান, যুগের দাবী সহ অনেক কাগজ ও সংকলনে। 'রানু আপা' ছদ্মনামে রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখেছেন ৬৯'এর আইয়ুব বিরোধী উত্তাল গণআন্দোলনে।

২৩ মার্চ ১৯৭১, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে লেখক সংগ্রাম শিবির আয়োজিত বিপ্লবী কবিতা পাঠের আসরে হাসান হাফিজুর রহমান, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন কবিরসহ অন্যান্য কবিদের সঙ্গে স্বরচিত কবিতাপাঠে অংশ নেন মেহেরুননেসা।এ আসরে সভাপতিত্ব করেছিলেন ড. আহমদ শরীফ। সেই অনুষ্ঠানে তিনি 'জনতা জেগেছে' কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন। সেদিনই তাঁর রচিত এ কবিতাটি 'বেগম' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

"জনতা জেগেছে
মুক্তি শপথে দীপ্ত আমরা দুরন্ত দুর্বার,
সাত কোটি বীর জনতা জেগেছি, এই জয় বাঙলার।
পাহাড় সাগর, নদী প্রান্তরজুড়ে-
আমরা জেগেছি, নবচেতনার ন্যায্য নবাঙ্কুরে।
বাঁচবার আর বাঁচাবার দাবি দীপ্ত শপথে জ্বলি,
আমরা দিয়েছি সব ভীরুতাকে পূর্ণ জলাঞ্জলি।
কায়েমী স্বার্থবাদীর চেতনা আমরা দিয়েছি নাড়া,
জয় বাঙলার সাত কোটি বীর, মুক্তি সড়কে খাড়া।
গণতন্ত্রের দীপ্ত শপথ কণ্ঠে কণ্ঠে সাধা-
আমরা ভেঙেছি, জয় বাঙলার যত বিজয়ের বাধা।
কায়েমী স্বার্থবাদী হে মহল! কান পেতে শুধু শোনো-
সাত কোটি জয় বাঙলার বীর! ভয় করিনাকো কোনো।
বেয়নেট আর বুলেটের ঝড় ঠেলে-
চির বিজয়ের পতাকাকে দেব, সপ্ত আকাশে মেলে।
আনো দেখি আনো সাত কোটি এই দাবির মৃত্যু তুমি,
চির বিজয়ের অটল শপথ, এ জয় বাঙলা ভূমি।"

২৩ মার্চ একাত্তরেই কবি মেহেরুন্‌নেসা ও তাঁর দুই ভাই মিরপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য রফিক ও টুটুল ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মিরপুরে নিজ বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। বিহারী অধ্যুষিত মিরপুরে তিনি ও তাঁর পরিবার অনেক আগে থেকেই চিহ্নিত হয়ে ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালী হিসেবে।
অবশেষে ২৭শে মার্চ এলো, দু'দিন আগেই ঢাকা'সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় তখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও বিহারীদের হাতে বাঙালি নিধন তথা গণহত্যা শুরু হয়ে গিয়েছে। মিরপুরের ৬ নম্বর সেকশনের ডি ব্লক, ১২ নম্বর রোডের ৮ নম্বর বাড়িতে সেদিন সংঘটিত হয়েছিল অমানবিক, পৈশাচিক, নির্মম হত্যাযজ্ঞ।

খোদার আরশ কি কেঁপেছিল সেই ক্ষণে ?

বেলা আনুমানিক ১১ টা থেকে ১২ টার ভেতর এ বাড়িতে হানা দেয় মিরপুরের 'কসাই' খ্যাত কাদের মোল্লার নেতৃত্বে মিরপুর এলাকার বিহারী হাসিব হাশমি, বিহারী আব্বাস চেয়ারম্যান, কুখ্যাত বিহারী আখতার গুন্ডা, বিহারী নেহাল গুন্ডা সহ আরও বেশ কিছু অমানুষ। 

দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকার মুহূর্তে কবি মেহেরুননেসা বুকে কোরআন শরিফ চেপে বলেছিলেন , ‘আমরা তো মুসলমান আমাদের মারবে কেন? যদি মারতেই হয় আমাকে মারো। ওদের কোনো দোষ নেই। ওদের ছেড়ে দাও।’ কিন্তু পাকিস্তানী ও তাদের এ দেশীয় দালাল হাইওয়ান'দের ভেতর কোন মনুষ্যত্ব ছিলোনা একাত্তরে, আজও নেই।

প্রথমেই কবি মেহেরুননেসার দুই ভাই রফিকুল ইসলাম বাবলু ও শহিদুল ইসলাম টুটুল'কে মেরে ফেলে জল্লাদের দল। প্রত্যক্ষদর্শী এক বিহারী'র (হত্যায় অংশ নেয়নি ও প্রতিবেশী) তথ্যে জানা যায় তাঁর দুই ভাইয়ের মাথা বিচ্ছিন্ন করে লাথি মারা হয়। কবি'র মা ছেলেদের মৃত্যু দেখে অজ্ঞান হয়ে গেলে তাঁকে সে অবস্থাতেই ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খণ্ড খণ্ড করে কাটা হয়। সবাইকে হত্যা শেষে কসাই কাদের ও আখতার গুন্ডা (প্রত্যক্ষদর্শী সেই বিহারীর ভাষ্যমতে) কবি মেহেরুননেসার মাথা বিচ্ছিন্ন করে, তাঁর লম্বা চুল দিয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দেয়। তাঁর পবিত্র রক্ত সেদিন পুরো কক্ষ জুড়ে ছিটকে পরেছিল।

না, আজ কবি মেহেরুননেসার জন্ম বা মৃত্যুদিন নয়। 'গেরিলা ১৯৭১', মনে করেনা তাঁদের শুধু বিশেষ দিনেই স্মরণ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রথম শহীদ নারী কবি মেহেরুননেসা এবং তাঁর পরিবারের সবাইকে স্মরণ করি গভীর বেদনায়, হৃদয়ের রক্তক্ষরন নিয়ে। তাঁর স্বপ্নের গ্রন্থটির নাম রেখেছিলেন, 'সূর্যজ্যোতির পাখি'। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়নি, তার আগেই নির্মম মৃত্যু কেড়ে নেয় সবকিছু থেকে। 

আমরা, তাঁর ও পরিবারের সকলের আত্মার চিরশান্তি প্রার্থনা করি।

'লানত' বর্ষিত হোক কসাই কাদের, আখতার গুন্ডা, আব্বাস চেয়ারম্যান, নেহাল গুন্ডাসহ সব খুনি, ধর্ষক, লুঠেরা বিহারীদের ওপর। পৃথিবীর সবটুকু লানত পরুক এদের ওপর, এদের পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। বংশ পরম্পরায় এই লানত তারা বয়ে বেড়াক।

তথ্য সুত্রঃ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খণ্ড; শহীদ কবি মেহেরুননেসাঃ কবি কাজী রোজী; ও মিরপুর ৬ সেকশনের স্থায়ী বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শী।

সংগৃহিত

এই বিভাগের আরো সংবাদ