বলিউড ১৯৭১ এর যুদ্ধকে কোন চোখে দেখেছে ?
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০১৯, ১৭:৩৭
স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ১৯৭১-র যুদ্ধ একটি অবিস্মরণীয় মাইলফলক - এবং সে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বলিউডে সেই যুদ্ধকে ঘিরে অনেক সফল চলচ্চিত্রও তৈরি হয়েছে।
কিন্তু তার বেশির ভাগই ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে, পূর্ব রণাঙ্গণে যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছিল তা নিয়ে সিনেমার সংখ্যা কিন্তু একেবারেই হাতেগানা।
একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে এসব ছবিতে প্রোটাগনিস্ট বা কেন্দ্রীয় চরিত্ররা বাংলা ভাষাভাষী, এমন ঘটনাও বেশ বিরল।
কিন্তু কেন বলিউডের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এভাবে উপেক্ষিত থেকে গেছে?
আর ভারতের পূর্ব সীমান্তের যুদ্ধ নিয়ে বলিউড যে অল্প কয়েকটি সিনেমা বানিয়েছে সেখানেই বা মুক্তিযুদ্ধকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে?
বলিউডের আইকনিক ছবি 'বর্ডারে'র সুপারহিট গান 'সন্দেশা আতি হ্যায়' আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে - যে ছবি বানানো হয়েছিল ১৯৭১য়ে রাজস্থান সীমান্তের মরুভূমিতে বিখ্যাত 'ব্যাটল অব লঙ্গেওয়ালা'কে কেন্দ্র করে।
আজও ভারতের স্বাধীনতা দিবসে টেলিভিশনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানো হয় 'বর্ডার', যার পরিচালক জে পি দত্তা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে বহু ছবি বানিয়েছেন।
কিন্তু একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি করার কথা কি তিনিও কখনও ভাবেননি?
মুম্বাইয়ের এই প্রবীণ পরিচালক বলছেন, "বাংলাদেশ যুদ্ধ নিয়ে ছবি বানাতে গেলে গণহত্যা দেখাতেই হবে - কিন্তু পর্দায় সেটা দেখাতে আমি কখনও স্বচ্ছন্দ বোধ করিনি।"
"যার জন্য শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল - অসংখ্য নারী-শিশু-পরিবারের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার সেই মর্মান্তিক কাহিনী সেলুলয়েডে তুলে ধরার সাহসটাই আমার ছিল না, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।"
"আর সে কারণেই ওই বিষয়টা আমি কখনও ছুঁয়ে দেখেনি", জানাচ্ছেন জে পি দত্তা।
কিন্তু বিষয়টা কি এতটাই সরল? গবেষক, ফিল্ম হিস্টোরিয়ান ও তথ্যচিত্র নির্মাতা পঙ্কজ বুটালিয়া এর একটা অন্য ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন।
"আমার ধারণা পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে আমাদের মাতামাতিটাই এর বড় কারণ। আমরা ভারতীয়রা সবচেয়ে যাকে ঘৃণা করি, সেটা পশ্চিম পাকিস্তান। নানা কারণে তাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কটাই সবচেয়ে জটিল।"
"আর দেশভাগের পর উত্তর ভারতে যারা শরণার্থী হয়ে এসেছিলেন তারা কিন্তু এসেছিলেন ওই ভূখন্ড থেকেই।"
"তাদের চাওয়া-পাওয়াই কিন্তু বলিউডের ন্যারেটিভটা স্থির করে দিয়েছে - আর একাত্তরের যুদ্ধের অন্য ন্যারেটিভটা রয়ে গেছে নজরের বাইরে।"
"বাংলাদেশ সৃষ্টির গুরুত্বটা তারা বুঝতেই পারেনি", বলছিলেন মি বুটালিয়া।
বলিউডের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় পরিচালকদের অন্যতম বর্ষীয়ান শ্যাম বেনেগাল - সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারও যাকে শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক নির্মাণের জন্য মনোনীত করেছে।
তিনিও বিবিসিকে বলছিলেন, "যে যা-ই ভাবুক, শেষ বিচারে একটা ফিল্ম কিন্তু দেশের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের ইচ্ছারই প্রতিফলন - নইলে হয়তো সে সিনেমা কোনওদিন চলবেই না।"
"সিনেমা একটা বাণিজ্য তা ভুললে চলবে না, নির্মাতারাও তা থেকে মুনাফাই করতে চান।"
"একাত্তরে পূর্ব রণাঙ্গনের রাজনীতিটা হয়তো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কিন্তু বলিউড চিরকাল রাজনীতির চেয়ে জনপ্রিয়তাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে", পরিষ্কার অভিমত শ্যাম বেনেগালের।
বলিউডের প্রযোজক ও লেখক, মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য 'ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ' সম্মানে ভূষিত প্রীতীশ নন্দীও অনেকটা একই মতের শরিক।
তার কথায়, "আসলে আমার ধারণা দুটোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হল ভারতের পশ্চিম সীমান্তে যে যুদ্ধ হয়েছিল সেটা ছিল ভারত বনাম পাকিস্তান। তার পলিটিক্যাল ডায়নামিক্সও ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।"
"আর ইস্টার্ন ফ্রন্টে যেটা হয়েছিল সেটা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই, ওদের নিজেদের লড়াই।"
"হ্যাঁ, ভারত তাতে অনেক সাহায্য করেছিল ঠিকই, কিন্তু ওরা নিজেরা লড়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। আর সেই স্বাধীনতার কেন্দ্রে ছিল বাংলা ভাষা।"
প্রীতীশ নন্দী এটাও মানেন, একাত্তরের যুদ্ধকে ঠিক কীভাবে দেখা হবে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তা নিয়ে একটা দৃষ্টিভঙ্গীর ফারাক আছেই।
বছরপাঁচেক আগে রিলিজ করেছিল বলিউডের একটি হিট ছবি, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া-রণবীর সিং-অর্জুন কাপুর অভিনীত 'গুন্ডে'।
একাত্তরকে কেন সেখানে 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ' না-বলে 'ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ' বলে বর্ণনা করা হয়েছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে অনুযোগ ও অভিমান ছিল বিস্তর।
সেটা সঙ্গত বলেই প্রীতীশ নন্দীর অভিমত - কারণ তিনি বিশ্বাস করেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের আবেগ মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে।
তিনি বিবিসিকে বলছিলেন, "বলিউড ভাষার ব্যাপারটা আসলে বোঝেই না। এই ইন্ডাস্ট্রিটা একটা আলাদা লিঙ্গুইস্টিক সংস্কৃতিতে বসবাস করে, যেখানে ছবির মূল ভিত্তিটাই হল শত্রুতা।"
"আজ অবধি বলিউডকে আমি এমন একটা যুদ্ধের ছবি বানাতে দেখলাম না, যেখানে বিজয়ী ও পরাজিতর মধ্যে বা দুই যুযুধান দেশের মধ্যে একটা কামারাডেরি বা মৈত্রীর বন্ধন থাকবে।"
"সব ছবিতে শুধু জেনোফোবিক ননসেন্স, আর শুধু 'আমরা জিতেছি, আমরা হারিয়েছি' করে চেঁচামেচি।"
"আর একটা ভিলেন থাকতেই হবে - কখনও সেটা পাকিস্তান, কখনও আলাউদ্দিন খিলজি - একটা জাতি যেন সর্বক্ষণ শুধু ভিলেন খুঁজে যাচ্ছে!"
একাত্তরে পূর্ব সীমান্তের দিকে নজর দিয়েও কিছু কিছু ছবি বলিউডে অবশ্যই হয়েছে, যার একটা হল 'গাজী অ্যাটাক' - বঙ্গোপসাগরে একটি পাকিস্তানি সাবমেরিনকে ডুবিয়ে দেওয়ার টানটান নৌযুদ্ধের কাহিনী।
সে সিনেমাতেই এক বাংলাদেশী ডাক্তারের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বলিউডে আজকের নামী অভিনেত্রী তাপসী পান্নু।
মাঝদরিয়ায় তাদের জাহাজ ডুবে গেলে ভারতীয় নৌবাহিনী শিশুকন্যা সমেত যাকে উদ্ধার করে।
স্ক্রিনে দর্শকরা দেখেছিলেন, ভয়ার্ত গলায় 'আমার সোনার বাংলা' গেয়ে সেখানে ভারতের সাবমেরিনের ভেতরে আশ্রয় পাওয়া তাপসী পান্নু নিজেকে বাংলাদেশী প্রমাণের চেষ্টা করছেন।
গবেষক পঙ্কজ বুটালিয়া জানাচ্ছেন, "বাষট্টির ভারত-চীন যুদ্ধের পর তবু দুটো খুব ভাল ছবি হয়েছিল, 'হকিকত' আর 'উসনে কহা'।"
"কিন্তু যুদ্ধ কখনওই বলিউডের প্রিয় থিম ছিল না, আর একাত্তরের যুদ্ধ নিয়ে সেভাবে তো কোনও মাস্টারপিসই তৈরি হয়নি।"
"প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম বা কোরিয়ার যুদ্ধ নিয়ে দুনিয়ায় যে সব সাঙ্ঘাতিক ছবি হয়েছে বলিউডের ওয়ার ফিল্মস তার সঙ্গে তো কোনও তুলনাতেই আসবে না।"
তবে পরিচালক শ্যাম বেনেগাল পাশাপাশি যোগ করছেন, "অবশ্য একাত্তরে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে কিন্তু কিছু মারাত্মক ট্যাঙ্ক ব্যাটল হয়েছিল।"
"সেগুলোকে তখনই অনেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিখ্যাত ট্যাঙ্কযুদ্ধগুলো - বিশেষ করে উত্তর আফ্রিকায় জেনারেল রমেলের অভিযানের সঙ্গে - তুলনা করতেন।"
"ফলে সেটাই বলিউডের কাছে 'সাবজেক্ট' হিসেবে বেশি আকর্ষণীয় থেকেছে।"
"তুলনায় পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রে ঘেরা নদীনালার বাংলাদেশে দাবার ছকের মতো ফর্ম্যাটে যুদ্ধের ছবি সহজে বানানো যাবে না - তাই পরিচালকরাও সেটা এড়িয়ে চলেছেন।"
তবু বছরপাঁচেক আগে মুক্তিযুদ্ধের এক অতি সংবেদনশীল দিক নিয়ে বলিউডে একটি অত্যন্ত সাহসী ছবি বানিয়েছিলেন তরুণ পরিচালক মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত।
পাকিস্তানি সেনা কীভাবে ধর্ষণকে যুদ্ধের নির্মম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল সেটাই ছিল 'চিলড্রেন অব ওয়ার' নামে সেই ছবির থিম।
ছবিতে বাংলাদেশের একজন 'বীরাঙ্গনা'র ভূমিকায় ছিলেন অভিনেত্রী তিলোত্তমা সোম।
"এটা এমন একটা জিনিস, যেখানে পারফর্ম করাটা আমার জন্য খুব বড় দায়িত্ব ছিল - কারণ খুব সহজেই এটা প্রহসন বা অতি-অভিনয় হয়ে যেতে পারে।"
"খুব বিশ্বাসযোগ্য ভাবে সেটা ফুটিয়ে তোলাটাই সেই জন্য ছিল আমার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।"
ধর্ষণের শিকার হয়েও কীভাবে একজন নারী পাশাপাশি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে পারেন, সেই ভাবনাই তাকে এই চরিত্রে অভিনয়ের সাহস জুগিয়েছিল - সে কথাই বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।
"তবু বলব অভিনয়ই তো, একজন অভিনেত্রীর জন্য সেটা আর কত কঠিন হতে পারে?"
"কিন্তু যখনই ভাবতাম বাংলাদেশের ছয় লক্ষ নারী এই চরম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছেন, তখনই মনে হত আমরা যেটা করছি সেটা তো ছেলেখেলা।"
"তবু সে ছেলেখেলার মধ্যেই কম মিথ্যে আর বেশি সত্যিটা কীভাবে বের করে আনব, এই ছবিটা করার সময় সেটা সব সময় মাথায় ঘুরত।"
"সেই অসমসাহসী মহিলাদের স্মৃতিতে এটুকু তো আমাদের করতেই হত, তাই না?", প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিলোত্তমা।
তার সেই অভিনয় যদি লক্ষ লক্ষ বীরাঙ্গনার প্রতি তার শ্রদ্ধাঞ্জলি হয়ে থাকে, 'চিলড্রেন অব ওয়ারে'র আর এক অভিনেতা ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত আবার বলছিলেন ধর্ষণের প্রভাব কী সাঙ্ঘাতিক হতে পারে - মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে এই ছবি সেটাই তাকে নতুন করে শিখিয়েছে।
তার কথায়, "এই ছবিটা করার আগে আমি কোনওদিন ভেবেও দেখিনি রেপ-কে কীভাবে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।"
"হ্যাঁ এটা নিশ্চয় জানতাম যে যুদ্ধের সময় যখন আর্মি ঢোকে তখন সেখানে রেপ হয় ।"
"কিন্তু সেটার প্রভাব যে কী সাঙ্ঘাতিক হতে পারে, সেটা যে কী মারাত্মক 'ওয়ার টুল' হতে পারে তা আমি কখনও কল্পনাই করতে পারিনি।"
"যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ধর্ষণের এই দিকটা আমি মুক্তিযুদ্ধের ওই ছবি করতে গিয়েই নতুন করে আবিষ্কার করেছি - তা বলতে আমার কোনও দ্বিধাই নেই!", বিবিসিকে সাফ জানাচ্ছেন ইন্দ্রনীল।
আসলে পূর্ব পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ নারীকে পরিকল্পিত ধর্ষণের মাধ্যমে একাত্তরের যুদ্ধের সময় একটা পুরো প্রজন্ম ও সমাজের মেরুদন্ডকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
মুম্বাইয়ের ফিল্মি দুনিয়া তবু অনেক দেরিতে হলেও সে বিষয়টাকে কিছুটা স্পর্শ করেছে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধর ছবি যে বিশাল ক্যানভাস জুড়ে আঁকা - সেই দুর্দান্ত লড়াই আর অসাধারণ মানবিকতার গল্প আজও বলিউডের রাডারে প্রায় পুরোটাই অধরা রয়ে গেছে। বিবিসি
এবিএন/মমিন/জসিম