আজকের শিরোনাম :

করোনা ভাইরাস: আর্থিক প্রণোদনা কী? কারা, কেন, কীভাবে পাবেন এই প্রণোদনা?

  সায়েদুল ইসলাম / বিবিসি বাংলা

১৭ জুন ২০২০, ০৯:৩৬ | অনলাইন সংস্করণ

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির ক্ষতি কাটাতে ৭২ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু আর্থিক প্রণোদনা কী? কারা পাবেন এই প্রণোদনা? কীভাবে তাদের দেয়া হবে?

করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনৈতিক খাত যে ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা কাটাতেই এই প্রণোদনা প্যাকেজ।

আর্থিক প্রণোদনা কী?
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনতে, উৎসাহ যোগাতে, ক্ষতি কাটাতে সহায়তা হিসাবে সরকারের তরফ থেকে যে আর্থিক প্যাকেজ বা বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়, সেটাই আর্থিক প্রণোদনা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগে ডিস্টিংগুইশড ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, সব ভর্তুকি প্রণোদনা নয়, তবে সব প্রণোদনাই ভর্তুকির একটি অংশ।

বিশেষ আর্থিক সহায়তা, ঋণ প্রদান, সুদ হার কমিয়ে দেয়া, আর্থিক প্যাকেজ, বিশেষ কর্মসূচী ঘোষণার মাধ্যমে প্রণোদন দেয়া যেতে পারে।

বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত পাঁচই এপ্রিল করোনাভাইরাসের আর্থিক ক্ষতি কাটাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেন।

এর মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়াও করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

এর আগেও বিভিন্ন সময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি আনতে সরকারের তরফ থেকে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এবারের মতো এতো বড় আকারের প্রণোদনা প্যাকেজ এর আগে আর দেয়া হয়নি।

আর্থিক প্রণোদনা কেন দেয়া হয়?
দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল রাখতে, বেকারত্ব রোধ করতে প্রণোদনা দেয়ার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।

সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, এই করোনাভাইরাসের মন্দার সময় বিশ্বের অনেক দেশ তাদের জিডিপির ৫০ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এইরকম বড় সংকটের সময় অনেক দেশকে এরকম প্রণোদনা দিতে হয়। না হলে তো ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা তাদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবেন না, বেতন ভাতা দিতে পারবেন না, লে-অফ করতে হবে।

"একদিকে যেমন ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, অন্যদিকে সরকারকে বড় ধরণের বেকারত্বের মুখোমুখি হতে হবে। অনেক দেশে যেমন বেকারত্বের ভাতা দিতে হয়। আমাদের এখানে সেরকম ভাতা না দিতে হলেও এটার একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্য আছে, সেটা সরকারকে বহন করতে হবে। সুতরাং অর্থনৈতিক দিক থেকে, চাকরির দিক থেকে, সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রণোদনার গুরুত্ব আছে", তিনি বলছেন।

কারা পাবেন
যখন সরকার কোন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে থাকে, তখনি সেখানে প্রণোদনা প্যাকেজটি কাদের জন্য সেটা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। পরবর্তীতে প্রণোদনা পাওয়ার শর্ত বা পদ্ধতিগুলো ঘোষণা করা হয়ে থাকে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তি, ব্যবসায়ী, শিল্প-কারখানার মালিক, কৃষকরা সাধারণত প্রণোদনার মূল লক্ষ্য হয়ে থাকেন।

করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটাতে যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, তার বেশিরভাগই ব্যবসায়ীরা পাবেন।

যেমন রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য স্বল্প সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এর ফলে মন্দার সময়েও শিল্প কারখানার মালিকরা অতিরিক্ত চাপ ছাড়াই তাদের কর্মী-শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে পারবেন। প্রথমে শিল্প মালিকরা এটি অফেরতযোগ্য মনে করলেও, পরবর্তীতে জানানো হয় যে, এটি আসলে ঋণ হিসাবে তাদের দেয়া হবে।

আবার মাঝারি-ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য যে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হয়েছে, সেটা দিয়ে আর্থিক ক্ষতি সামাল দিতে পারবেন এই ব্যবসায়ীরা। তারা মন্দা কাটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে পারবেন। এভাবে কৃষক, রফতানি-কারকরা একই রকম সুবিধা পাবেন।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, গরীব মানুষদের নগদ সহায়তা, খাদ্য সহায়তার বরাদ্দকে অনেকে ভর্তুকি বলতে পারেন। কিন্তু এটাও আসলে প্রণোদনা। কারণ এর মাধ্যমে তাদের টিকে থাকতে সহায়তা করা হচ্ছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে অর্থ যোগ হচ্ছে।

করোনাভাইরাস ছাড়াও সরকারের নিয়মিত কিছু প্রণোদনা রয়েছে। যেমন রেমিট্যান্স আসলে তার সঙ্গে এখন ২ শতাংশ অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা হচ্ছে। এটাও একপ্রকার প্রণোদনা, যার মাধ্যমে হুন্ডি বা অবৈধ উপায় এড়িয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আনতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

অনেক সময় প্রণোদনার অর্থ ফেরতযোগ্য হয়, আবার অনেক সময় হয় অফেরতযোগ্য। প্রণোদনা দেয়ার সময় এই শর্ত উল্লেখ থাকে।

কীভাবে দেয়া হয়?
সাধারণত ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করেই সরকারি প্রণোদনা দেয়া হয়ে থাকে।

করোনাভাইরাসের ক্ষতি কাটাতে যে প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, সেগুলো পেতে হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংকের ওপর নির্ভর করতে হবে।

কারণ সরকার এই প্রণোদনা ঘোষণা করলেও এর বেশিরভাগটা ব্যাংক থেকে ঋণ হিসাবে দিতে হবে।

গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোর বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য সরকার যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল, সেটা সরাসরি সরকার দিয়েছে। কিন্তু বাকি প্রণোদনাগুলোর বেশিরভাগই ব্যাংক নির্ভর।

করোনাভাইরাসের ক্ষতি মেটাতে বাংলাদেশের সরকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও, তার কিছু সরকারের তহবিল থেকে আসবে, বাকিটা ব্যাংকগুলো ঋণ হিসাবে দেবে।

সেই ঋণের সুদের একটি অংশ বহন করবে সরকার। ফলে ঋণ দেয়ার আগে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা, অতীত আর্থিক লেনদেনের ইতিহাস, ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেবে।

তবে প্রান্তিক মানুষদের সহায়তায় সরাসরি যে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়, সেটা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বা সরাসরি তাদের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে।

আবার রেমিট্যান্সে যে প্রণোদনা দেয়া হয়, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো সরাসরি গ্রাহকদের হিসাবে প্রদান করে।

সবাই কি সুবিধা পাচ্ছেন?

বাংলাদেশের একটি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডি একটি গবেষণায় দেখতে পেয়েছে, গার্মেন্টস শ্রমিক ও ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোক্তাদের একটি বড় অংশ এই প্রণোদনা প্যাকেজগুলোর সুবিধা পাচ্ছেন না। সিপিডি’র জরিপ অনুযায়ী, শুধুমাত্র প্রায় ১৫ শতাংশ শ্রমিক তাদের এপ্রিল মাসের পুর্ণাঙ্গ বেতন পেয়েছেন, বাকিরা কেউ আংশিক পেয়েছেন এবং প্রায় ২৫ শতাংশেরও বেশি শ্রমিক হয় অর্ধেকেরও কম বেতন পেয়েছেন কিংবা একেবারে কিছুই পাননি। প্রায় ৬৩ শতাংশ শ্রমিক তাদের বাসাভাড়া পরিশোধ করতে পারেন নি, জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৩৫ শতাংশ শ্রমিকদের স্ত্রী বা স্বামী বর্তমানে কর্মহীন অবস্থায় রয়েছেন।

সিপিডির ওয়েবসাইটে জুন মাসের ৯ তারিখে প্রকাশিত ওই গবেষণার তথ্যে গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাগণ অনিশ্চিত অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়েছেন। তারা ব্যাংক থেকে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরো আন্তরিকভাবে সহযোগিতার পরামর্শ প্রদান করেন তিনি।

ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ হিসাবে প্রণোদনা দেয়া হলে সেটা সবাই পান না। কারণ তখন শুধু ব্যবসায়ীর ক্ষতি বা আর্থিক অবস্থার তুলনায় ব্যাংকের নানা শর্ত, বিবেচনা বা সম্পর্ক বেশি গুরুত্ব পায়। কারণ তখন ব্যাংক বিবেচনা করে, গ্রহীতা সেটা ঠিকভাবে ফেরত দিতে পারবে কিনা।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষক নাজনীন আহমেদ বলছেন, "প্রণোদনার বেশিরভাগ সুফল ভোগ করে যারা ফর্মাল সেক্টরে একটু এগিয়ে রয়েছে, যাদের সঙ্গে ব্যাংকের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি যে মানুষটা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অনানুষ্ঠানিক খাতে ব্যবসা করছে, ব্যাংকে বেশি লেনদেন নেই, তার জন্য কিন্তু এটা উপকার করে না। শেষ পর্যন্ত ভালনারেবল গোষ্ঠী বেশি সুবিধা পায় না।"

আর্থিক প্রণোদনার সুফল কতটা?
নাজনীন আহমেদ বলছেন, প্রণোদনায় অবশ্যই সুফল আসে, কিন্তু সেটা কীসের বিনিময়ে? এটা গ্রাহক পর্যায়ে দাম কমায়, আবার সেটা সরকারের দায় বাড়িয়ে দেয়। যেমন বাজেট ঘাটতি বাড়িয়ে দেবে। প্রণোদনার অর্থ কোথায় থেকে আসবে?

"সার্বিকভাবে প্রণোদনা সাহায্য করে, ক্রাইসিস কাটিয়ে উঠতে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে একটা বড় কস্ট (মূল্য) আছে, সেটা সরকার ব্যাংক থেকেই ঋণ নিক বা বিদেশ থেকে, সেটার সুদ দিতে হবে। সেটা অর্থনীতির ওপর একটা চাপ আসে। তারপরেও সরকার এই চাপটা নেয়, কারণ এই মুহূর্তে মানুষকে সাহায্য করতে হবে, সাহায্য না করলে অনেকে পুঁজি নষ্ট হয়ে আগামীতেও তারা চলতে পারবে না", বলছেন নাজনীন আহমেদ।

সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন, "ফেরতযোগ্য বা অফেরতযোগ্য প্রণোদনা হোক না কেন, সেটা অর্থনীতিকে গতিশীল করে। কারণ এটা একদিকে যেমন ব্যবসায়ীদের ব্যবসা-কারখানা চালু রাখতে সাহায্য করে, পাশাপাশি চাকরি রক্ষার মাধ্যমে, অথবা অর্থনীতিতে অর্থ সঞ্চার হওয়ার কারণে স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতি গতিশীল হয়।"

তবে তিনি বলছেন, অনেক সময় প্রণোদনা তার টার্গেট গ্রুপের কাছে যেতে পারে না। যত দ্রুত এটা বাস্তবায়ন হওয়া উচিত, সেটাও হয় না। যা দেয়া হয়, তাদের ক্ষেত্রেও হয়তো চাহিদার পুরোপুরি মেটাতে পারে না। কিন্তু এটা যদি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে উদ্যোক্তা, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এটা খুব ভালো ফলাফল আনে।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ