সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর: উদ্বেগে বাংলাদেশের অনেক ক্ষুদ্র আয়ের মানুষ
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০১৯, ২১:১২
ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা শাহিদা পারভিন স্বামীর পেনশন হিসেবে পাওয়া পুরো টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন, যা দিয়ে তাদের সংসারের খরচ চলে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আগে থেকেই সাংসারিক বাজেটে টানাটানি শুরু হয়েছিল। আর এই বাজেটে উৎসে কর বাড়িয়ে দেয়ায়, তারা পড়েছেন আরো সংকটে।
শাহিদা পারভিন বলছেন, ''সঞ্চয়পত্রের টাকা আর কিছু জমিজমা থেকে যে আয় হয়, তা দিয়েই ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বাড়িভাড়া, সংসার খরচ চলে। এমনিতেই সব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। এখন আমাদের আয় যদি আরো কমে যায়, তাহলে তো সংসারে তার প্রভাব পড়বেই।''
সঞ্চয়পত্রের ওপর তার কেন এই নির্ভরশীলতা?
দেশের নারী, বয়স্ক নাগরিক এবং অবসরে যাওয়া সাবেক চাকরিজীবীদের একটি বড় অংশ, তাদের পারিবারিক আয়ের ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্রের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
দেশের ব্যাংকগুলোর তুলনায় সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বেশি হওয়ায় অনেকেই এই খাতে বিনিয়োগে উৎসাহী হন।
শাহিদা পারভিন বলছেন, ''ব্যাংকে সুদের হার কম। ব্যবসা বাণিজ্য তো আর এই বয়সে করতো পারবো না। তাই সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছি, যাতে সহজে মুনাফা পাওয়া যায়। আবার পোস্ট অফিস থেকে তুলতে পারি বলে ঝামেলা হয় না।''
এতদিন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা তোলার সময় পাঁচ শতাংশ হারে উৎসে কর দিতে হতো, এখন থেকে তাদের দিতে হবে ১০ শতাংশ হারে।
সঞ্চয়পত্রের ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর বহাল রেখে রোববার বাংলাদেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে।
উৎসে কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে সরকার?
সঞ্চয়পত্রে উৎস্যে কর বাড়ানোর কারণে অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়বে বলে মনে করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মোঃ মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া।
তিনি বলছেন, ''সঞ্চয়পত্রের ওপরে এখন চাপ খুব বেশি। দেশের মোট মানি সাপ্লাইয়ের এক চতুর্থাংশ সঞ্চয়পত্রে জমা আছে।"
অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, "সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেয়া হলে ব্যাংকগুলোতে টাকা আসবে।''
তবে সরকার এটাও চিন্তা করেছে, সুদের হার কমিয়ে দিলে সাধারণ মানুষ, যাদের অনেকেই সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল, তারা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেজন্য এবার সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানো হয়নি বলে জানান মিস্টার ভুঁইয়া।
কিন্তু একটা কর আরোপ করা হয়েছে। যেন কিছু অর্থ ব্যাংকিং খাতে যায়। সেইসঙ্গে বন্ড বা এ ধরণের বিনিয়োগ কিছুটা বাড়ে।- বলছেন মি. ভুঁইয়া।
অভিযোগ আছে যে, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই উচ্চ সুদের সুবিধাটি চালু করা হলেও অনেক ধনী ব্যক্তি নামে বেনামে সঞ্চয়পত্র কিনে সুবিধা নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক নাজনীন আহমেদ মনে করেন, যেভাবে বিপুল পরিমাণে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে অর্থনীতি ও সরকারের জন্য বড় ধরণের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
তিনি বলছেন, মানুষ সঞ্চয়পত্র কেনে, কারণ অন্য যেসব সঞ্চয়ের উপাদান আছে, তার চেয়ে এখানে সুদের হার বেশি। আবার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করছে সরকার, যেহেতু তারা অতিরিক্ত সুদ দিচ্ছে, তখন অতিরিক্ত বিক্রি হলে সরকারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুদের একটা বোঝা তৈরি করছে। সেটা কিন্তু সরকারকেই ভবিষ্যতে প্রদান করতে হবে। ফলে এটা সরকারের ব্যয় বা দায়ের ওপর একটা প্রভাব ফেলবে। ''
''সেই প্রভাব কিন্তু দেশের অর্থনীতিতেও পড়তে বাধ্য, যদি না রাজস্ব বা অন্য আদায় থেকে আয়টি অনেকগুণ বাড়ে। কিন্তু সেটা যদি না হয়, তাহলে সুদের হার হিসাবে যে বিপুল অর্থ দিতে হবে, সেটা সামষ্টিক অর্থনীতি ও সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে।''
গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ বলছেন, একদিকে সরকার যেমন নারী ও বয়স্কদের আয়ের ব্যবস্থা করার জন্য সঞ্চয়পত্রে চড়া সুদ বহাল রাখছে, আবার এই উৎস কর আরোপ করে তাদের আয় কমিয়ে দিচ্ছে।
তাই তার মতে, সরকারের বরং উচিত, সঞ্চয়পত্রের সুবিধাটি শুধুমাত্র নারী, বয়স্কা বা নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, তাহলে তারা অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা পাবে, আবার দেশের অর্থনীতির জন্যও সেটি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না। বিবিসি
এবিএন/মমিন/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ