আজকের শিরোনাম :

ফিরে দেখা ২০১৮

হাইলাইটস ব্যাংকিং খাত

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ০১:১২ | আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০১৯, ০১:২৫

বিদায় নিচ্ছে ২০১৮ সাল। অর্থনীতিতে এ সালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর অতিক্রম করেছে। বছরজুড়েই আলোচিত-সমালোচিত ঘটনার মধ্যে দিয়ে সালটি বেশ স্মরণীয় ছিলো। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মাধ্যমে ব্যাংকিং পাড়া বেশ সরগরম হয়ে উঠে। এর সমানুপাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভে থাকা স্বর্ণ চুরির মাধ্যমে বড় ধরনের ঘটনায় ২০১৮ সালও বেশ আলোচিত হয়েছে। এদিকে বিগত বছর সরকারি ও বেসরকারি অনেক ব্যাংক নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে অনৈতিকভাবে জনগণের অর্থের অপব্যবহার করে। যার ফলাফল ২০১৯ সালে তীব্রভাবে দেখা দিতে পারে।

অর্থনীতির ধারক-বাহক ব্যাংক খাত। ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ পরিচালনা পর্ষদের স্বেচ্ছাচারিতায় গুরুত্বপূর্ণ এ খাতে চলছে চরম অস্থিরতা।

বিদায়ী বছরজুড়ে ব্যাংক খাতে আলোচনায় শীর্ষে থাকা উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো:

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে থাকা স্বর্ণ চুরি

সাড়ে ৮শ কোটি টাকার ডিজিটাল চুরির রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ভল্টে জমা রাখা স্বর্ণের গরমিল’ নিয়ে দেশব্যাপি তোলপাড় ছিলো। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ৪০ দিন গোপন ছিলো। রিজার্ভ চুরির কেলেঙ্কারি মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখা ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের সোনার চাকতি ও আংটি, তা হয়ে আছে মিশ্র বা সংকর ধাতু। ছিল ২২ ক্যারেট স্বর্ণ, হয়ে গেছে ১৮ ক্যারেট। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এ ভয়ংকর অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচন করা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি সোনা পরীক্ষা করে বেশির ভাগের ক্ষেত্রে এ অনিয়ম ধরা পড়ে। প্রতিবেদনটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট কাস্টম হাউসের গুদাম কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ গোলাকার কালো প্রলেপযুক্ত একটি সোনার চাকতি এবং একটি কালো প্রলেপযুক্ত সোনার রিং বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই চাকতি এবং আংটি যথাযথ ব্যক্তি দিয়ে পরীক্ষা করে ৮০ শতাংশ (১৯ দশমিক ২ ক্যারেট) বিশুদ্ধ সোনা হিসেবে গ্রহণ করে প্রত্যয়নপত্র দেয়। কিন্তু দুই বছর পর পরিদর্শন দল ওই চাকতি ও আংটি পরীক্ষা করে তাতে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১ দশমিক ২ ক্যারেট) সোনা পায়। আংটিতে পায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ সোনা (৩ দশমিক ৬৩ ক্যারেট)। ধারণা করা হচ্ছে ভল্টে রাখার পর এগুলো পাল্টে ফেলা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, ভল্টে থাকা সোনার চাকতি এবং আংটি পরীক্ষার পর দেখা গেল এগুলো সোনার নয়, অন্য ধাতুর মিশ্রনে তৈরি। এতে সরকারের ১ কোটি ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিদর্শন দল প্রতিটি রসিদের অনুকূলে জমা হওয়া সোনা যাচাই করেছে। তাতে দেখা গেছে, সোনার অলংকার এবং সোনার বারে ক্যারেটের তারতম্য করা হয়েছে। ২৪ থেকে ২০ ক্যারেটের ৯৬০ কেজি সোনার বেশির ভাগের ক্ষেত্রে ভল্টে ১৮ ক্যারেট হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়েছে। কম ক্যারেটে নথিভুক্ত থাকায় নিলাম বা অন্য উপায়ে বিক্রির সময় অতিরিক্ত ক্যারেটের বিপরীতে প্রাপ্য টাকা থেকে সরকার বঞ্চিত হবে। সোনার ক্যারেটের তারতম্য ঘটানোর কারণে সরকারের ১ কোটি ৯০ লাখ ৮৫ হাজার ৩৪৬ টাকা ৬৭ পয়সা ক্ষতির সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

বেড়েছে খেলাপি ঋণ

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আট লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৯৮ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ নয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।

এদিকে, বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ব্যাংকের নানা অনিয়মের খবর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংক, এনআরবিসি ও রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ক্রিসেন্ট ও এননটেক্স গ্রুপের ঋণ অন্যতম।

অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ডুবতে বসা ফারমার্স ব্যাংক জাগাতে মূলধন জোগানসহ নেয়া হয় নানা উদ্যোগ। ব্যাংকটির নামও পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়া হয়। নতুন প্রজন্মের এ ব্যাংককে বাঁচাতে এক হাজার ২১৫ কোটি টাকা মূলধন সহায়তা দিতে এগিয়ে আসে সরকারি চার ব্যাংক ও একটি বিনিয়োগ সংস্থা। এর মধ্যে ৮১৫ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে, আরও ৪০০ কোটি টাকা দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া শুরু থেকে ব্যাংকটিতে এসব প্রতিষ্ঠানের ৫৫০ কোটি টাকা ধার রয়েছে। মূলধন সহায়তা দিয়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক এবং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হয়েছে।

শীর্ষ ২৫ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৯৫০০ কোটি টাকা

দেশের শীর্ষ ২৫টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের পরিমাণ সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকারও বেশি। এসব প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এ ঋণ নিয়েছে। এই ঋণখেলাপির তালিকায় আলোচিত হলমার্ক কোম্পানির একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ২৫টি প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ নয় হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্সের খেলাপি ঋণ সর্বোচ্চ ৮৮৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেমস লিমিটেডের কাছে ৫৫৮ কোটি নয় লাখ টাকা, জাসমির ভেজিটেবল ওয়েল লিমিটেড ৫৪৭ কোটি ৯৫ লাখ, ম্যাক্স স্পিনিং মিলস ৫২৫ কোটি ৬০ লাখ, বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ ৫১৬ কোটি ৯৪ লাখ, ঢাকা ট্রেডিং হাউজ ৪৮৫ কোটি ২৯ লাখ, আনোয়ার স্পিনিং মিলস ৪৭৪ কোটি ৩৭ লাখ, সিদ্দিক ট্রেডার্স ৪২৮ কোটি ৫৭ লাখ, ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ ৪১৪ কোটি ৮০ লাখ, আলফা কম্পোজিট টাওয়েলস লিমিটেড ৪০১ কোটি ৭৩ লাখ, লিজেন্ড হোল্ডিংস ৩৪৭ কোটি ৮৫ লাখ, হলমার্ক ফ্যাশন লিমিটেড ৩৩৯ কোটি ৩৪ লাখ, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল ৩৩৮ কোটি ৭৪ লাখ, মুন্নু ফেব্রিক্স ৩৩৮ কোটি ৩৭ লাখ, ফেয়ার ট্রেড ফেব্রিক্স লিমিটেড ৩২২ কোটি ৪ লাখ, শাহারিশ কম্পোজিট টাওয়েল লিমিটেড ৩১২ কোটি ৯৬ লাখ, নুরজাহান সুপার ওয়েল লিমিডেট ৩০৪ কোটি ৪৯ লাখ, কেয়া ইয়ার্ন লিমিটেড ২৯২ কোটি ৫৩ লাখ, সালেহ কার্পেট মিলস লিমিটেড ২৮৭ কোটি ১ লাখ, ফেয়ার ইয়ার্ন প্রসেসিং লিমিটেড ২৭৩ কোটি ১৬ লাখ, এসকে স্টিল ২৭১ কোটি ৪৮ লাখ, চৌধুরী নিটওয়ার লিমিটেড ২৬৯ কোটি ৩৮ লাখ, হেল্প লাইন রিসোর্সেস লিমিটেড ২৫৮ কোটি ৩০ লাখ, সিক্স সিজন অ্যাপার্টমেন্ট লিমিটেড ২৫৪ কোটি ৫৭ লাখ, বিসমিল্লাহ টাওয়েলস লিমিটেডের ২৪৩ কোটি ৮৪ লাখ।

দেশের শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ

দেশে ঋণখেলাপির সংখ্যা ২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮ ও তাদের কাছে পাওনা অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৬৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি বেগম পিনু খানের এক প্রশ্নের জবাবে এই তথ্য জানান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এসময় তিনি শীর্ষ ১০০ ঋণ খেলাপির তালিকাও প্রকাশ করেন।

সংসদে দেওয়া অর্থমন্ত্রীর তালিকা অনুযায়ী শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির মধ্যে রয়েছে মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড,কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেম লি., ম্যাক্স স্পিনিং মিলস, রাবেয়া ভেজিটেবল ওয়েল ইন্ডাট্রিজ, রাইজিং স্টিল মিল, ঢাকা ট্রেডিং হাউজ, বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ, আনোয়ারা শিপিং মিলস, ক্রিসেন্ট লেদার প্রোডাক্টস, ইয়াসির এন্টার প্রাইজ, চৌধুরী নিটওয়ার,সিদ্দিক ট্রেড, রুপালী কম্পোজিট লেদার ওয়ার, আলফা কম্পোজিট টয়েলস হলমার্ক ফ্যাশন লিমিটেড, মুন্নু ফেব্রিক্স, ফেয়ার ইয়ার্ন প্রসেসিং লিমিটেড, ফেয়ার ট্রেড ফেব্রিক্স, শাহরিজ কম্পোজিট টয়েল লিমিটেড, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, সুরুজ মিয়া শিপিং মিলস,প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেড, সালেহ কার্পেট মিল, পদ্মা পলি কটন নিট ফেব্রিক্স, এ কে স্টিলের নাম।

এসমসয় অর্থমন্ত্রী জানান, ঋণ খেলাপিদের কাছে অনাদায়ী অর্থের পরিমাণ বাংলাদেশের সর্বশেষ প্রণীত বাজেটের এক চতুর্থাংশেরও বেশি। ৮৮ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে এই ঋণ নেয়া হয়েছে।

মূলধন ঘাটতিতে ৯ ব্যাংক

ব্যাংকের টাকা ক্যালেঙ্কারি, লুটপাত, মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে এটি নিত্যদিনের ঘটনার মতই প্রভাব পড়ছে। বলা যায় এক ধরণের ভাটা চলছে এ সেক্টরে । দেশের প্রধান সেবা মূলক ব্যাংকিং খাত দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে। আস্থা হারাচ্ছে গ্রাহকদের।কমছে মূলধন।

এদিকে ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে গ্রাহকদেরকে টাকা ফেরত দিতে পারছে না ফারমার্স ব্যাংক। শুধু তারাই নয়, এমন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আরও ডজনখানেক ব্যাংক। এর মধ্যে ৯টি ব্যাংক ইতোমধ্যে তার মূলধন ভেঙে খাওয়া শুরু করেছে। এছাড়া নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে আরও একডজন বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের মার্চ প্রান্তিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে এই ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ এখন ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেকটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরও ভয়ঙ্কর তথ্য। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনও ব্যাংকের শীর্ষ ১০ গ্রাহক খেলাপি হয়ে যান, তাহলে ৩৮ ব্যাংক নতুনভাবে মূলধন ঘাটতিতে পড়বে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে ৯টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এর মূলধন ঘাটতি এখন ৭ হাজার ৭৭৬ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। মূলধন ঘাটতির দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সোনালী ব্যাংক। তাদের মূলধন ঘাটতি ৫ হাজার ৩৯৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৬৫৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ৮১৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ৬৩৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা ও জনতা ব্যাংকের ১৬১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে।

এছাড়া বেসরকারি খাতের আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ফারমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ২৮২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ২৪৫ কোটি ৫২ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৭ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনও ব্যাংকের সাতজন করে গ্রাহক ঋণখেলাপিতে পরিণত হলে ৩৪ ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি দেখা দেবে। আর তিনজন করে গ্রাহক খেলাপি হলে ১৯টি ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বিবেচনা করে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বর্তমানে একটি ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ বা ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে যেটি বেশি সেই হারে মূলধন সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে ঋণমান অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে হয়। কিন্তু খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে পারছে না দেশের ১২টি ব্যাংক।

সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ শেষে ১২টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। এই সময়ে প্রভিশন ঘাটতির শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক। এর ঘাটতি এখন ৩ হাজার ৯৪৯ কোটি টাকা। এছাড়া বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা ও রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা।

অন্যদিকে নতুনভাবে প্রভিশন ঘাটতিতে যুক্ত হয়েছে এবি ব্যাংক। এর ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৫৫ কোটি টাকায়। এছাড়া আইএফআইসি ব্যাংকের ঘাটতি ২৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঘাটতি ১১৪ কোটি টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি ১৪০ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ঘাটতি ১২০ কোটি টাকা ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৮ কোটি টাকায়।

বেসিক ব্যাংক থেকে আট হাজার কোটি টাকা হাওয়া

এক সময়ের আদর্শ ব্যাংক বলে খ্যাত রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক এখন দেউলিয়ার পথে। ব্যাংকটি থেকে গত ৮ বছরে বিভিন্ন ভুয়া কোম্পানির নামে আট হাজার কোটিরও বেশি টাকা পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে বার বার জনগণের করের টাকা দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত জুন মাসে ব্যাংকটিকে মূলধন ঘাটতি পূরণে একহাজার কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। আর গত ৪ বছরে বেসিক ব্যাংকের লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, ব্যাংকটির ৬৮টি শাখার মধ্যে ২১টিই লোকসান গুনছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর আমলের চার বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকা বের করে নেওয়া হয়। ২০১৪ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে আরও প্রায় চার হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকটির গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগরসহ কয়েকটি শাখা থেকে নামসর্বস্ব শতাধিক কোম্পানির নামে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয় অনিয়মের মাধ্যমে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কয়েকটি ঋণ প্রস্তাব নিয়ে ব্যাংকের শাখাগুলো থেকে পর্যবেক্ষণে নেতিবাচক জানানো হওয়ার পরও বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ঋণ সংক্রান্ত কমিটি তা উপেক্ষা করে ঋণ অনুমোদন করে। ওই ঘটনায় এমডিকে বরখাস্ত করে পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। পরে আলাউদ্দিন এ মজিদকে চেয়ারম্যান এবং খোন্দকার মো. ইকবালকে এমডি করে নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়। কিছুটা গতি আসে ব্যাংকটিতে। তবে মুহাম্মদ আউয়াল খান এমডি হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার পর আবারও গতি হারিয়েছে ব্যাংকটি।

বেসিক ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি গত বছরে ৬৮৪ কোটি টাকা নিট লোকসান করেছে। সব মিলিয়ে গত চার বছরে বেসিক ব্যাংকের নিট লোকসান হয়েছে ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালেও প্রায় ৬৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছিল ব্যাংকটি। ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ২ কোটি ৭৮ লাখ টাকায়। পরের বছর ২০১৩ সাল থেকে লোকসান শুরু হয়। ২০১৩ সালে ৫৩ কোটি, ২০১৪ সালে ১১০ কোটি, ২০১৫ সালে ৩১৪ কোটি ও ২০১৬ সালে ১ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা নিট লোকসান করে বেসিক ব্যাংক।

বেসিক ব্যাংকের এমডির পদত্যাগ

রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ আউয়াল খান পদত্যাগ করেছেন। ১২ অথবা ১৪ আগস্ট তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মজিদের কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। সে কারণে খারাপ অবস্থা দেখে এমডি সরে গেছেন।

ছয়-নয় সুদহার

সুদহার সিঙেল ডিজিটে নামানোর দাবি ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের। সুদহার কমাতে সরকারের উচ্চ মহল থেকেও চাপ দেয়া হয়। ফলে বছরের মাঝামাঝিতে ব্যাংক আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশ ও ঋণে ৯ শতাংশ নামিয়ে আনার ঘোষণা দেন বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক ও ব্যবস্থাপকরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এমন প্রতিশ্রুতি দেন তারা। বিগত জুলাই মাস থেকে বাস্তবায়নের কথা বলে ব্যাংকগুলো সরকারের কাছ থেকে কর্পোরেট করহার কমানোসহ নানা সুযোগ-সুবিধাও পায়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এখনও ১০ শতাংশের ওপরে ঋণের সুদ আদায় করছে বেশির ভাগ ব্যাংক। ছয়-নয় সুদহারকে নয়-ছয় বুঝিয়ে নানা টালবাহানা করছেন ব্যাংকাররা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ডাবল ডিজিটে (১০ শতাংশের বেশি) ঋণের সুদ আদায় করছে দেশি-বিদেশি ২৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক।

শর্তসাপেক্ষে অনুমোদনে পেয়েছে তিন ব্যাংক

দেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের ‘কমিউনিটি ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। আর সব শর্ত পূরণ না করায় লাইসেন্স না দিয়ে অপেক্ষায় রাখা হয়েছে পিপলস ব্যাংক, বেঙ্গল ব্যাংক ও সিটিজেন ব্যাংককে।

সূত্রমতে, নতুন ব্যাংকের জন্য ২০১১ সালে আবেদন চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় জমা পড়ে ৩৭টি আবেদন। সরকারের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নয়টি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়। যদিও আর কোনো ব্যাংকের অনুমোদন না দেয়ার পক্ষেই মত ছিল আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির। ২০১২ সালে ওই নয় ব্যাংকের অনুমোদনের পর ২০১৬ সালে অনুমোদন পায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) উদ্যোগে সীমান্ত ব্যাংক। এরপর আরো কয়েকটি ব্যাংককে অনুমোদন দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে সুপারিশ পাঠায় অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রতিটি সুপারিশের উত্তরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন ব্যাংক অনুমোদন দিতে আপত্তির কথা জানায়।

এবিএন/শংকর রায়/জসিম/পিংকি

 

এই বিভাগের আরো সংবাদ