সুনামগঞ্জে ধানের বাম্পার ফলনেও কৃষকরা দিশেহারা
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৯, ১৪:৩০
সুনামগঞ্জে শাল্লার ছায়ার হাওরে একশ কেদার জমি রোপন করেছিলেন কৃষক মাহবুব হোসেন। ৪০ কেদার জমি নষ্ট হয়েছে শিলায়। বাকি ৬০ কেদার জমি ভাগালু এনে ধান কাটা মাড়াই শেষে ৬০০ মণ ধান পেয়েছেন তিনি। মোট খরচ হয়েছে তার ৪ লাখ টাকা। ধান কাটা শ্রমিক সংকটের কারণে এ খরচ বেড়েছে এবার। একজন শ্রমিকের মজুরি দৈনিক ৭০০ টাকা করে গুনতে হয়েছে। এক মণ ধানের দর ৫৫০ টাকা মিলছে। অথচ একজন শ্রমিকের মজুরি তার চাইতে বেশি। তিনি ধানে খুশী হলেও দরে অখুশী।
তিনি জানালেন ধানের দর বাড়লে ধার দেনা পরিশোধ করে ক্ষতি পুষিয়ে বছর চলত খুশীতে। তিনি আরও আক্ষেপ করে বললেন, কোন বছরই সরকারি খাদ্য গুদামে সিন্ডিকেটের কারণে ধান দিতে পারিনি। সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ১০৪০ টাকা দরে ধান কিনলে এ ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব হতো। নইলে এ পেশায় ঠিকে থাকা দায়। আগামীতে শ্রমিক সংকট কাটাতে বেশি করে কম্বাইন্ডার হারভেস্টার মেশিন সরবরাহ করলে কৃষক বাঁচবে বলে ও মন্তব্য করেন তিনি। শুধু মাহবুব হোসেন নয় এ রকম বক্তব্য হাওরাঞ্চলের প্রতিটি কৃষকের।
কৃষকরা জানান, কৃষি আমাদের আদি পেশা। এ পেশা ছেড়ে হাল ধরি কিসে। বিকল্প কোন কর্মসংস্থানও নেই। অনেক কষ্টে ফলানো ফসল গোলায় তোলার পর যখন লোকসান গুনতে হয় কিংবা আসলে আসল থাকে তখন মনে হয় এ পেশা ছেড়ে বিকল্প কিছু ভাবতে হবে।
তারা আরো জানান, খাদ্য গুদামে প্রকৃত কৃষকরা কখনো ধান দিতে পারে না। এবার ধানের মণ সরকারি দরে ১০৪০ টাকা ধরা হয়েছে। এ দামে সরকার সরাসরি ধান কিনলে হাসি ফুটতো কৃষকের মুখে। কিন্তু এ সুযোগ কি আমাদের আছে। দেখার হাওরে প্রান্তিক কৃষক নুরুল আমীনের সাথে কথা হয় তার বাড়িতে। তিনি এ প্রতিবেদককে জানালেন কৃষিতে তার দু:খের কথা।
তিনি বলেন, এবার ৮ কেদার জমিতে ধান রোপন করেছি। ৮০ মণ ধান তুলেছি গোলায়। প্রতি কেদারে ৪০০০টাকা করে খরচ হয়েছে। ধানের দর ৫৫০-৬০০ টাকা হওয়ায় লাভবান হওয়াতো দুরের কথা ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি। তিনি এও বললেন, এবার দেড় মণ ধানে এক বস্তা সারের টাকা মিলছে। বর্গাচাষীদের অবস্থাতো আরো খারাপ। কৃষকদের সর্বনাশ হচ্ছে। এ পেশা ধরে রাখতে পারবো না আর। ধানের দাম বাড়ানো উচিত। এবং খাদ্য গুদামে ১০৪০ টাকা করে আমাদের ধান কিনলে লাভবান হতে পারবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। কৃষক রমিজ, লতিফ জানান, কৃষকের দু:খ কেউ বুঝে না। নেতারা কৃষকদের পক্ষে কথা বলে মাঠ গরম করে। আদতে কাজের কাজ কিছুই না।
২০১৭ সালের ফসল ডুবির অভাব এখনও রয়ে গেছে। বোরো আবাদের সময় সব কৃষককে ঋণ করতে হয়। ধান পেলে সেই ঋণ শোধ করে বউ বাচ্চা নিয়ে সুন্দর জীবন যাপন করেন। কিন্তু সরকার ঋণ থেকে কৃষককে এখনও মুক্ত করতে পারেনি।
খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার ৬ হাজার ৫শত ৮ মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। পাশাপাশি ১৭ হাজার ৭৯৮ মেট্রিক টন আতব চাল ও ১৪ হাজার ১৭৯ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল কিনবে সরকার। এসব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে জেলায় ৯ লক্ষ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। তার তুলনায় ৬ হাজার ৫০৮ মেট্রিক টন ধান খুবই অপ্রতুল। অথচ ৫ গুণ বেশি চাল কিনবে সরকার। এসব চাল দিবে মিলাররা। পুঁজিপতিরাই হচ্ছে লাভবান। সর্বশান্ত হচ্ছে কৃষক।
কৃষকরা জানালেন, চাল বেশি না কিনে ধান বেশি কেনা উচিত। এতে লাভবান হবে প্রান্তিক কৃষক। সরকার যদি চাল কেনার একান্তই বেশি প্রয়োজন হয় তাহলে কৃষকদের ধান মিলে ভাঙ্গিয়ে চাল করে কিনতে পারতেন। এমনটি না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করছেন কৃষক। সদর ও বিশ্বম্ভরপুর আসনের এমপি পীর মিছবাহ ও সংরক্ষিত আসনের শামীমা খানুম সংসদেও বাহিরে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো ও সরাসরি প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার দাবি জানিয়েছেন।
এ দিকে হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর ও সরাসরি কৃষকদের ধান সংগ্রহের দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক জাকারিয়া মুস্তফা জানান, সরাসরি কৃষকদের ধান ক্রয়ের জন্য উপজেলায় উপজেলায় মাঠ পর্যায়ে মহিলা কৃষক ও প্রান্তিক কৃষকের তালিকা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২/১টি উপজেলায় ধান সংগ্রহের অভিযান শুরু হয়েছে। ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। সরকার সেটি নিয়ে ভাবছে।
এবিএন/অরুন চক্রবর্তী/গালিব/জসিম
এই বিভাগের আরো সংবাদ