আজকের শিরোনাম :

তালায় উপ-প্রকল্প বাস্তবায়নে স্তরে স্তরে দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭ মে ২০১৯, ১০:২২

সাতক্ষীরার তালা উপজেলার বালিয়া ভাঙ্গনকূল টেকসই ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ৪ কোটি ৮২ লাখ ২৩ হাজার ১৯১ টাকার কাজে ব্যাপক দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পে কোন রকম দায়সারাভাবে কাজ করে প্রকল্প সম্পন্ন করতে যাচ্ছে সেখানকার কথিত বালিয়া ভাঙ্গনকূল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লি.।

কপোতাক্ষ নদের সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খেশরার বালিয়া, ডুমুরিয়া, শাহাজাতপুর ও খেশরা এলাকার ১২ কি. মি. ভেড়িবাঁধের ভাঙ্গনরোধ ও জলাবদ্ধতা দূরীকরণে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধিনে টেকসই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ পায় তারা। তবে শুরু থেকেই প্রকল্পে আছর করে নানা দুর্নীতি-অনিয়ম।

 

১২ কি. মি. প্রকল্প এলাকার ৪/৫টি স্থান ভেঙ্গে প্লাবিত হতো পুরো অঞ্চল। ২০০৯ সালের আইলায় অঞ্চলের ৯৫০ হেক্টর জমির ৮০০ হেক্টরই লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। ভেঙ্গে পড়ে পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি এবং লক্ষাধিক বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ মরে সাবার হয়। প্রায় ৩শ হেক্টর উঁচু ফসলী জমিতেও ৫/৭ বছরের মধ্যে কোন ফসল হয়নি। শতাধিক পুকুরে এখনও অস্থিত্ব রয়েছে আইলার লোনা পানির। উপযুক্ত রেগুলেটর না থাকায় মৌসুমের বর্ষার পানি সরাতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় এলাকাবাসীদের।

এমন পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ঝুঁকি থেকে পরিত্রাণের জন্য ২০১১ সালে এলজিইডির ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন বিভাগ এ অঞ্চলে প্রকল্পটি গ্রহণে সমীক্ষা পরবর্তী কর্তৃপক্ষ ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ২০১৮ সালের জুন মাসের মধ্যে ১২ কি. মি. ভেড়িবাঁধ এবং ৭.৫ কি. মি. খাল খননের কাজ ৫২টি এলসিএস দলের ১১০০ শ্রমিকের ৪ মাসের কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়নে বালিয়া ভাঙ্গনকূল সাব প্রজেক্ট (এসপি নং-৬১০০১) হাতে নেয়। এ ছাড়া ঠিকাদারের মাধ্যমে ৩টি রেগুলেটর, ৪টি পাইপ স্লুইস এবং সমিতির অফিস ঘর নির্মাণসহ মাটির কাজ বাস্তবায়নে শর্ত সাপেক্ষে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। যার স্মারক নং ৪৬.০২.৮৭০০.০০০.০০.০০০.১৭.৩২১৪। তাং-০৪.১২.২০১৭।

অভিযোগে প্রকাশ, প্রকল্প বাস্তবায়নে নথি নং-৪৬.০২.০০০০.১৪.০০৩.১৭.৩২০ এর অধিকাংশ শর্ত পূরণ করেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন বালিয়া ভাঙ্গনকূল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লি.।

বিশেষ করে পাবসস কর্তৃক গঠিত মান নিয়ন্ত্রণ উপ-কমিটি উপ-প্রকল্পের গুণগতমান গাইড লাইন অনুযায়ী তদারকী ও অবকাঠামো বাস্তবায়নে যথাযথভাবে অবকাঠামো সমূহের গুণগতমান নিয়ন্ত্রণের কথা থাকলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অজ্ঞাত কারণে তাদের নজরদারি ছিলনা প্রকল্পে। 

এ ছাড়া নথি নং-৪৬.০২.০০০০.১৪.০০৩.১৭.৩২১ এর শর্তানুযায়ী এলসিএস দ্বারা মাটির কাজ বাস্তবায়ন, অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে পূর্ত কাজের বিল পরিশোধ, ডিজাইন ও স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী বাঁধ ও খালের মাটি কাজের টপ, বটম, হাইট, এবং স্লোপ, রেফারেন্স লাইন এর কাজ বাস্তবায়ন, ডিজাইনের বাইরে কাজ না করাসহ বিভিন্ন শর্ত থাকে। এ ছাড়া প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার ৭ দিনের মধ্যে উল্লেখিত ব্যবস্থা গ্রহণ, পাবসস এর নির্মাণ কাজ পরিবীক্ষণকারী উপ-কমিটি দ্বারা বাস্তবায়ন কাজ পরিদর্শন ও মতামত সাইট অর্ডার বুক এ লিপিবদ্ধ করণ, সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তরের (জিওবি ও প্রকল্পে জনবল) ও উপজেলা প্রকৌশল দপ্তরের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রি-ওয়ার্ক (কাজ শুরুর পূর্বে) ও পোষ্ট-ওয়ার্ক ডিজাইন মাফিক কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর মাপ গ্রহণ করে লেভেল শীট সংরক্ষণপূর্বক তা সদর দপ্তরে প্রেরণ, লেভেল শীটের মাধ্যমে মাটির কাজের বিল পরিশোধ, প্রি ওয়ার্ক ও পোস্ট ওয়ার্ক উভয় ক্ষেত্রে স্বাক্ষরকারী সকলের মোবাইল নং ও নামসহ সীল থাকা, (১০০ মি. বা তার কম পরপর লালকালি দ্বারা গাছে বা স্থায়ী পাকা স্থাপনায় আরএল ও চেইনেজ উল্লেখ, খাল খননের ক্ষেত্রে খননের পূর্বে ও পরে অবস্থার পূর্ণাঙ্গ ভিডিও চিত্র ধারণ করে সংরক্ষণ ও প্রকল্প অফিসে প্রেরণের কথা থাকে।

বাঁধের দৃঢ়করণের ক্ষেত্রে ১৫০-২০০ মি.মি. প্রতি স্তর পুরুত্বে মাটি ভরাট করে কোদাল/মুগুর দিয়ে বড় ধরণের ঢেলা/চাকা ভেঙ্গে ৭ কেজি ওজনের দরমুজ দিয়ে দৃঢ়করণ, বাঁধের পার্শ্বঢালের আগাছা পরিষ্কার করে সিঁড়ির মত ধাপ কেটে বেঞ্চিং তৈরী করে মাটি ফেলা, দুই পাশের ঢালে ঘাস লাগানো, (ভেটিভার গ্রাস অগ্রগণ্যসহ) প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়নাধীন স্কীমের প্রতি মাসের বাস্তব ও আর্থিক অগ্রগতি প্রতিবেদনের হার্ড ও সফট কপি পরবর্তী মাসের ৩ তারিখের মধ্যে প্রেরণ করতে হবে, প্রকল্পের কাজ সদর দপ্তরের প্রতিনিধি পরিদর্শনের পর কাজের মান নিয়ন্ত্রণ ও গুণগতমান সম্পর্কে মতামত দেয়ার পর চুড়ান্ত বিল প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে খুলতে হবে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ তহবিল একাউন্ট। মাটির কাজ ৩ শতকরা পাকা কাজের জন্য ১.৫ শতকারা হারে ঐ একাউন্টে অর্থ জমা থাকতে হবে। প্রতিটি এলসিএস গ্রুপ তৈরীর ক্ষেত্রে ২০-২৫ জন পুরুষ/মহিলা সদস্য থাকতে হবে। যার মধ্যে ১/৩ অংশ মহিলা সদস্য হতে হব। অথবা শধুমাত্র পুরুষ দ্বারা বা শুধুমাত্র মহিলা দ্বারাও এলসিএস গঠন করা যাবে। খাল ও বাঁধের কাজ চলতি অর্থ বছরের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে ডিজাইন মোতাবেক সম্পন্ন করতে হবে।

এ দিকে বালিয়া ভাঙ্গনকুল কাগুজে উপ-প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও আশংকামুক্ত নয় ঐ এলাকা। তবে সমিতির (এলসিএস) একাংশের দাবি, ১২ কি.মি. ভেড়িবাঁধ নির্মাণ হওয়ায় তারা সুফল ভোগ করতে শুরু করেছেন। এ ছাড়া খাল খননে পানি নিষ্কাশনের সমস্যা দূর হওয়ায় ১৫০ হেক্টর নিচু জমিতে এখন ফসল ফলছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। তবে এলাকাবাসীর আশংকা, বর্ষার আগে রেগুলেটর নির্মাণের কাজ শেষ না হলে পুরো এলাকা ফের পানিতে তলিয়ে থাকবে। বর্ষা মৌসুমের আগে ঠিকাদার রেগুলেটর নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারলে এ অঞ্চলের দুর্যোগ ঝুঁকি অনেকটা নিরসন হবে। তাদের ধারণা, ২৪০০ পরিবারের ৯০০ হেক্টর জমির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, স্বার্থক হবে সরকারের প্রায় ৫ কোটি টাকার প্রকল্প।

অন্যদিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে এলসিএস গ্রুপের একটি অংশ খুশী হলেও অপর বড় অংশিটির পাশাপাশি খুশী হতে পারেনি সাধারণ এলাকাবাসী। জোনা খাল ২নং এলসিএস দলের মফিজুল মোড়ল জানান, তাদের দলের ২২ জন শ্রমিক ১ বছর আগে সাড়ে তিন লক্ষ টাকার কাজ শেষ করেছে। অথচ টাকা পেয়েছে মাত্র দেড় লক্ষ। বাঁধ নির্মাণ ৪নং এলিএস এর সভাপতি বাবলুর রহমান শেখ জানান, তার দল এক বছর আগে ৪.৫ লক্ষ টাকার কাজ শেষ করলেও এ পর্যন্ত মাত্র দেড় লক্ষ টাকা পেয়েছে। আরও কয়েকজন এলসিএস দলের সভাপতি ও সম্পাদক একই অভিযোগ করেন। এনিয়ে এলাকাবাসীর একাংশের দাবি,প্রকল্পে এলসিএস দলগুলোর মাধ্যমে ঝুঁড়ি-কোদাল দিয়ে মাটি কর্তনের কথা থাকলেও মাটি কর্তন ও বাঁধ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে স্কেভেটর।

এ প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা বালিয়া ভাঙ্গনকুল পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেড এর সভাপতি আমিনুল ইসলাম জানান, ৫২টি এলসিএস দলের মধ্যে ৪৪টি দল জুন ২০১৮ এর মধ্যে তাদের কাজ শতভাগ সম্পন্ন করেছে। প্রতিকূল অবস্থার কারণে ৮টি এলসিএস দল গত বছর কাজ শেষ করতে পারেনি। এ মাসের মধ্যে তাদের কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। তবে তার এমন বক্তব্য বাস্তবতাকে বহুলাংশে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রকৃত পক্ষে এলসিএস সদস্যরা নামমাত্র লোক দেখানো কাজ করলেও মূলত যেটুকু কাজ হয়েছে তার সিংহ ভাগই করা হয়েছে স্কেভেটর দিয়ে।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ কুমার কুন্ডু বলেন, প্রক্রিয়া শেষ হলেই এলসিএস দলের সদস্যরা বকেয়া টাকা পাবেন।

এবিএন/সেলিম হায়দার/গালিব/জসিম
 

এই বিভাগের আরো সংবাদ