আজকের শিরোনাম :

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বন্ধুর স্মৃতি ‘মাথার খুলি’ নিয়ে নিরবে কাঁদেন আলী আহমদ চান্দুু

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৬:৪৭

১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল শনিবার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু প্রায় ১মাস। দুপুর প্রায় দেড়টা। প্রতিদিনের মত বাবা ডা. ইজাজুল হকের সাথে ঘোষপট্টি ঔষধের দোকানে  হোমিও এবং কবিরাজি চিকিৎসা শিখেন আলী আহামদ চান্দু। তিনি তখন কটিয়াদী পাইলট বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র।

তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান ও বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মামা মরহুম আসাদুজ্জামান কিশোরগঞ্জ থেকে খবর পেয়ে সাইকেল যোগে এসে স্থানীয় এলাকাবাসীকে জানান, পাকবাহিনী কটিয়াদী আক্রমন করবে। খবর পেয়ে এলাকার লোকজন দিগ¦বিদিক ছুটাছুটি শুরু করে।



এসময় বাজারের দোকান থেকে আলী আহমদ চান্দু পালানোর সময় দেখেন প্রায় ৩০০ গজ দূরে পাকহানাদার বাহিনী হামলা করছে কটিয়াদী পৌরসভার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা পশ্চিম পাড়ায়। পাকহানাদার বাহিনী তখন এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়লে চান্দু তখন প্রাণ বাঁচাতে বিদ্যাসুন্দর দাসের বাড়ির পশ্চিম পাশে পুকুরে ঝাঁপ দেন।  কচুরিপানা মাথায় দিয়ে নিজেকে আড়াল করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ দেখেন চান্দু। এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন বিভীষিকাময় একটি দিনের গল্প।   

ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে বিদ্যাসুন্দর দাস, তার ছেলে (চান্দুর প্রিয়বন্ধু) রঞ্জিত দাস, ক্ষেত্র মোহন ঘোষ, মিহির কান্তি রায়, অশ্বিনী সূত্রধরসহ ৭জনকে ধরে নিয়ে আসে পার্শ্ববর্তী তিন রাস্তার মোড়ে এবং সেখানেই ৭ জনকে একসাথে সারিবদ্ধ করে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে গুলিচালিয়ে  হত্যা করে পাক সেনারা। শুধু তাতেই ক্ষান্ত হয়নি তারা। রঞ্জিত দাস, তার বাবা বিদ্যাসুন্দর দাস ও ক্ষেত্র মোহন ঘোষকে বন্দুকের বেনট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃতদেহ থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে যায় পাকবাহিনী। ঠিক এমন ভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন কটিয়াদী পৌর এলাকার হালুয়াপাড়া  গ্রামের বাসিন্দা মরহুম ডাঃ ইজাজুল হকের তৃতীয় পুত্র কবিরাজ, হোমিও ডাক্তার, যাদু শিল্পী, চিত্রশিল্পী, সংগ্রাহক, বৃক্ষপ্রেমী আলী আহাম্মদ চান্দু।

বহুমূখী প্রতিভার অধিকারী চান্দু’র অত্যন্ত প্রিয়বন্ধু ছিলেন রঞ্জিত দাস। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বন্ধুসহ ৭জনের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের দৃশ্যটি অবলোকন ছাড়া কিছুই করার ছিল না তার।  মেনে নিতে পারেননি এই পৈশাচিকতা। ভেতরে ভেতরে ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন বারবার। রঞ্জিত দাস, তার বাবা বিদ্যাসুন্দর দাস ও ক্ষেত্র মোহন ঘোষের দেহ বিছিন্ন মাথা ছালার ব্যাগে করে নিয়ে আসেন এবং দোকানের পিছনে মাটি গর্ত করে পুতে রাখেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রিয় বন্ধু রঞ্জিত দাস তার বাবা বিদ্যা সুন্দর দাস ও ক্ষেত্র মোহন ঘোষের মাথার খুলি গর্ত থেকে তুলে ধুয়ে মুছে সযত্নে ঘরে রাখেন ডাঃ চান্দু।

তিনি র্দীঘ ৪৭ বছর ধরে নিয়মিত যত্ন করে সেই একাত্তরের স্মৃতিকে আগলে ধরে রেখেছেন। মাঝে মাঝেই সেই নির্মমতা স্মরণে আতকে উঠেন এখনো তিনি।

একজন ঐতিহাসিক সংগ্রাহকও ডাঃ আলী আহমদ চান্দু। ব্রিটিশ শাসন আমলের সোলজারদের বার্মীস্টার, ভোরাক, রামলক্ষন , রামের রাজ দরবার , হনুমান (ওয়ান আনা),  হনুমানের নিক্তি সম্বলিত কয়েন, কায়েদী আজমের (ওয়ান হান্ড্রেড রুপি), স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্থান (পাঁচ টাকা)সহ বিভিন্ন আমলের প্রায় ৩শতাধিক মুদ্রা সংগ্রহে রেখেছেন আলী আহাম্মদ চান্দু।

১৯৭৪ সালের জাহাজের মাস্তুলে থাকা হেডলাইট (হারিকেন), দিকদর্শন যন্ত্র (কম্পাস), ঢাকার এক কুট্টির বাসা থেকে ক্রয় করা ব্রিটিশ আমলের একটি ক্যামেরা, চট্টগ্রামের এক সওদাগরের কাছ থেকে ১৯০৫ সালে ক্রয় করা দূরবীক্ষন যন্ত্র (বাইনোকুলার), ৫০ কেজি তরল পদার্থ ধারন করা ক্ষমতা সম্পন্ন একটি ঔষধ মিশ্রন কাচের বোতল যা ইংল্যান্ড থেকে ঔষধ সরবরাহের ক্ষেত্রে একসময় ব্যবহৃত হতো।

১৯৭৩ সালে একটি কলের গান সংগ্রহ করেন। যা ভারতবর্ষের প্রথম কলের গান। ১০ টি গ্রামোফোন ও ৩ টি চেঞ্জার বা রের্কড প্লেয়ার রয়েছে তার সংগ্রহে। কলের গানের রের্কড রয়েছে প্রায় ১২শতাধিক। ১৯৭১ সালে পাকিস্থানের বেলুজ রেজিমেন্টের এক সেনা কর্মকর্তার দেয়া প্রজেক্টরও রয়েছে তার সংগ্রহে।

বৃক্ষ প্রেমী হিসেবেও সফল ড্ঃা আলী আহমদ চান্দু। দূর্লভ ঔষধি ফুলের গাছ প্লেসিফ্লোরা ও অ্যাসট্রোলোফিয়া রয়েছে ওনার বাগানে। যা চিন্তামুক্ত ও শ্বাসকষ্ট রোধে খুবই কার্যকর । রয়েছে সুন্দরবনের সুন্দরী এবং হারগুজা বা হরকোজ গাছ। হারগুজা একটি কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ। যে কাঁটার ভয়ে বাঘ বা সিংহ বনের ভেতর প্রবেশ করতে চায় না। গ্রীনটি, লাল পদ্ম, নীল পদ্ম ছাড়াও ইন্ডিয়া, কানাডা, আমেরিকা, অষ্টেলিয়ারসহ বিভিন্ন দেশের  দূর্লভ প্রায় ২০০ প্রজাতির বিভিন্ন ঔষধি ও ফলজ বৃক্ষ রয়েছে। ফলজ বৃক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক ২০১৭ সালে শুভেচ্ছা সম্মাননা করেন আলী আহামদ চান্দু।
 

এবিএন/রাজীব সরকার পলাশ/জসিম/তোহা

এই বিভাগের আরো সংবাদ