সহিংসতার কী প্রভাব নোয়াখালীর ভোটারদের মধ্যে?
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৭:৪৬
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পর থেকেই আলোচনায় নোয়াখালী। কারণ এই জেলার ৬টি নির্বাচনী আসনের ৫টিতেই বিভিন্ন সময় সংর্ঘষ-সহিংসতার কারণে জাতীয় গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়েছে।
নোয়াখালী-১ আসন। চাটখিলের দিঘিরপাড় গ্রাম। তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা, শীতের আবহটাও বেশ স্পষ্ট। ধানক্ষেতে কাজ করছিলেন কয়েকজন কৃষক। তাদেরই একজন ফোরকান গাজী। তিনি বলছিলেন, "ভোটের পরিবেশ তো এখনো ঠিক হয় নাই।"
সুষ্ঠু পরিবেশ না হলে তিনি ভোট দিতে যাবেন না বলেও জানান, "গ্যাঞ্জাম হচ্ছে, পরিবেশ ভালো হইলে আমরা ভোট দিতে যাবো, না হইলে যাবো না। মারামারি হইলে তো ভোট দিতে যাওয়া যাবে না। আগের বার মারামারির মধ্যে ভোট দিতে পারি নাই। আরেকজন আমার ভোট দিয়ে ফেলাইছে।"
অন্য দুজন কৃষকও একই রকম কথা বললেন। চাটখিলের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চলে আসি সোনাইমুড়ি বাজারে। বাজারটি বেশ বড় এবং বিভিন্ন ধরণের মানুষের আনাগোনাও বেশি।
বাজারে নৌকা ও হাতপাখা মার্কার কিছু পোস্টার দেখা গেলো। কিন্তু এখানেও ভোটারদের মনোভাবে পার্থক্য দেখা গেলনা। আবুল হাশেম দীর্ঘ ২০ বছর প্রবাসে ছিলেন। গত দশ বছর ধরে অবশ্য তিনি দেশেই ছোট-খাট ব্যবসা করছেন।
তিনি বলছেন, ভোটের সেরকম কোন আমেজ দেখা যাচ্ছে না। "এখানে তেমন কোন আমেজ দেখতে পাচ্ছি না। একটা আতঙ্ক আতঙ্ক ভাব। মারামারির কারণে আমরা এখনো বুঝতে পারতেছি না ভোটটা কেমন হবে।"
বোঝা যাচ্ছে, ভোটের উৎসব ছাপিয়ে এসব এলাকায় একধরণের ভীতি আর আশঙ্কা কাজ করছে অনেকের মধ্যে। যার মূল কারণ এই আসনের সোনাইমুড়িতে গত ১৫ই ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ-বিএনপি'র মধ্যে নির্বাচন-কেন্দ্রীক সহিংসতা।
সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন বিএনপি'র প্রার্থী । ভাংচুরের ঘটনা ঘটে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কার্যালয়সহ বেশ কয়েকটি দোকানে।
সেই ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-পুলিশের মধ্যে এখনো পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ ও দোষারোপ চলছে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেই সংঘর্ষের পর থেকেই ধানের শীষের প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারে এক ধরণের স্থবিরতা নেমে এসেছে। কোন কোন এলাকায় কিছু পোস্টার দেখা গেলেও চাটখিলে দলটির কার্যালয় তালাবদ্ধ।
ধানের শীষের প্রার্থী মাহবুব উদ্দীন খোকন তখন চিকিৎসার জন্য অবস্থান করছিলেন নোয়াখালী সদরে। প্রচারণা কম সেটি স্বীকার করলেও ঐক্যফ্রন্টের এই প্রার্থী বলছিলেন, ভোটের লড়াইয়ে তার দলেরই জয় হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
"যেভাবে হামলা হচ্ছে, তাতে নেতা-কর্মীদের প্রচারণায় ঘাটতি তো হচ্ছেই। লোকজনও ঘাবড়ে গেছে।"
তিনি বলেন, "কিন্তু আমাদের আত্মবিশ্বাস আছে যে, নির্বাচনে আমরাই জিতবো। এজন্য আমরা মাঠ ছাড়বো না। যদি ভোটের দিনটাতেও পরিবেশ সুষ্ঠু থাকে তাহলে জনগণ আমাদের পক্ষেই রায় দিবে বলে মনে করি।"
১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই আসনের পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলোতে শতভাগ জয়ের রেকর্ড আছে বিএনপি প্রার্থীদের। আর সবগুলো নির্বাচনেই বিএনপি'র নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো আওয়ামী লীগ। এর বাইরের আসনগুলোতেও বেশিরভাগ সময় জয় হয়েছে বিএনপির। সে কারেই হয়তো এতটা আত্মবিশ্বাস উঠে আসে মাহবুব উদ্দীন খোকনের কথায়।
যদিও বিএনপি'র আগের সেই অবস্থান এখন আর নেই বলেই মনে করছেন নৌকা মার্কার প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহিম।
তার ভাষায়, "উন্নয়নের কারণেই এবার জয় হবে আওয়ামী লীগের।"
চাটখিলে আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী পথসভা শেষে তার সাথে আলাপকালে তিনি যেমনটা বলছিলেন, "গত কয়েকবছরে এই এলাকায় অনেক উন্নয়ন হয়েছে, সারাদেশেই হয়েছে।"
"এখানে চাঁদাবাজি নেই, সন্ত্রাস নেই। মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছে। আমরা আমাদের উন্নয়নের কথা প্রচার করছি। মানুষ আমাদেরই ভোট দেবে।" নোয়াখালী-১ আসনে প্রার্থী আছেন আরো ৬ জন।
হাতপাখা মার্কায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর এম এরফান খান, লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে জাতীয় পার্টির আবু নাছের ওয়াহেদ ফারুক, কুলা প্রতীকে বিকল্প ধারার মো: ওমর ফারুক, বটগাছ প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের জিয়াউল হক, চেয়ার প্রতীকে ইসলামিক ফ্রন্টের শাহ আলম এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আপেল প্রতীক নিয়ে বোরহান উদ্দীন।
তবে ভোটাররা মনে করছেন, মূল প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে নৌকা আর ধানের শীষ' এর মধ্যেই। কিন্তু নোয়াখালীর অন্য আসনগুলোতে নির্বাচনী লড়াইয়ের পরিবেশটা কেমন?
নোয়াখালী-৪ আসনে আমি কথা বলি কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরুর পরপরই সহিংসতায় যে দুটি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিলো, তার একটি এই আসনে।
শুধু তাই নয়। দেখা যাচ্ছে নোয়াখালীতে যে ৬টি নির্বাচনী আসন রয়েছে, তার মধ্যে অন্তত: ৫টিতেই নির্বাচনকে ঘিরে একাধিক সংঘর্ষ কিংবা হামলার ঘটনা ঘটেছে।
আর এসব নিয়ে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানাচ্ছেন কয়েকজন ভোটার।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভোটারদের মনের ভীতি দূর করে নির্বাচনী পরিবেশ কতটা অনুকূলে রাখতে পারবে স্থানীয় প্রশাসন?
এমন প্রশ্নে নোয়াখালীর রিটার্নিং কর্মকর্তা তন্ময় দাস বলছিলেন, "নোয়াখালীতে শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী যারা আছে - তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। এরপর থেকে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটেছে।"
"এটা শতভাগ নিশ্চিত ভোটের দিন ভোটারররা ভোট কেন্দ্রে যাবেন এবং অত্যন্ত আনন্দ মুখর পরিবেশেই তারা ভোট দিতে পারবেন। এখানে কোনও সন্দেহ নেই।"
ভোটারদের মধ্যে কোনরকমের ভীতি আছে বলে মনে করছেন না এই নির্বাচন কর্মকতা। যদিও বাস্তবতা ভিন্ন কথাই বলছে।
এমন অবস্থায় নির্বাচন পর্যন্ত পরিস্থিতি কেমন থাকে তার ওপরই নির্ভর করছে এখানকার ভোটের লড়াই কতটা জমজমাট হয়ে উঠবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।
এবিএন/মমিন/জসিম