আজকের শিরোনাম :

রাণীশংকৈলে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত খুনিয়া দিঘীটিও বেদখল

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১৫:৫২

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আসলেই ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার হানাদারদের সেই লোমহর্ষক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের কথা স্মরণ করে শিউরে ওঠে মুক্তিযোদ্বাসহ এই উপজেলার মানুষের।
বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাধীনতাকামী নিরীহ লোকজনকে ধরে এনে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে ঐতিহাসিক খুনিয়া দীঘির পাড়ে একটি শিমুল গাছের সাথে হাতের তালুতে লোহার পেরেক গেঁথে ঝুলিয়ে রেখে রাইফেলের বাট ও বেনোটের দিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানোর পর দীঘির পাড়ে দাঁড় করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যার পর হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা লাশ ভাসিয়ে দিত দীঘির পানিতে। সেখানেই লাশগুলো পঁচে গলে পানির সাথে মিশে রক্তে রঞ্জিত লাল হয়ে যেত পুরো দিঘী। হাজার হাজার লাশ আর রক্তে দীঘির পানির রং সব সময়ই থাকতো লালচে।
খান সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় এলাকার যুবতি ও সুন্দরী নারীদের পিতা-মাতা এবং স্বামীর উপস্থিতিতেই ধরে এনে ক্যাম্পে আটকে রেখে চালাতো পাশবিক নির্যাতন। এ হত্যাযজ্ঞের কথা মানুষ আজো ভুলেনি। তবে অতি দুঃখের বিষয়  পুকুরটি র্দীঘদিন ধরে বেদখল থাকলেও ২০১৫ সালের দিকে সেটি আবার বিক্রি হয়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ পুকুর বিক্রয় বা বেদখল থাকলেও উদ্বারে প্রাশসন বা সরকারের কোন দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
হোসেনগাও ইউনিয়ন ভুমি অফিস সুত্রে জানা যায়,১৯৬২ সালের ষ্টেট একুইজিশনে(এসএ) খুনিয়াদীঘি জলকর হিসেবে মেহের বকস সরকারের ছেলে কুশুম উদ্দীনের নামে রের্কড ছিল। তবে সেখানে জমির কোন পরিমাণ উল্লেখ্য ছিল না। ১৯৮২ সালে জমির পরিমাণ ২ দশমিক ১৮ একর উল্লেখ্য করে কুশুম উদ্দীনের ছেলে হামিদুর রহমান দিনাজপুরের তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের কাছে জমি খারিজের আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে খারিজের আদেশ পান হামিদুর রহমান। খারিজের পর থেকে খাজনা দেওয়া শুরু করেন হামিদুর রহমান । এরপর তিনি ২০১৫ সালে ৮নং ওর্য়াড আ’লীগের নেতা আবুল কাশেমের স্ত্রী ফাতেমা বেগমের কাছে বিক্রয় করে দেন।
উপজেলা সেটেলম্যান্ট অফিস সুত্রে জানা যায়, সর্বশেষ ভুমি জরিপে খুনিয়াদিঘীটি এখনও খাস খতিয়ান হিসেবে আমাদের দপ্তরে লিপিবদ্ব রয়েছে।  
পুকুর বিক্রির খবর শুনলে গা শিউরে ওঠে স্বাধীনতাকামি মানুষের। ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের বর্ণনা করেন ঠাকুরগাঁওয়ের শহীদ পরিবারের সদস্য রাণীশংকৈল ডিগ্রী কলেজ অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম তিনি মুক্তিযুদ্ধে ভাই নজরুল ইসলামের কথা স্মরণ করে বলেন, পাক সেনারা তাকে খুনিয়া দিঘীতে যেভাবে হত্যা করেছে তা তিনি বর্ণনা দিয়ে শেষ করতে পারবেন না। 

তিনি আরো বলেন- বিয়ের ছয় মাসের মাথায় এক নারীর  স্বামীকে ধরে নিয়ে যায় পাক সেনারা। ক্যাম্পে আটকে রেখে রাতে তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালায় ওরা। পরদিন সকাল বেলায় সলিম উদ্দীন নামক এক রাজাকার তার কাছে এসে জানায়, তিনি ক্যাম্পে গেলে তার স্বামীকে ছেড়ে দেয়া হবে। তার কোন ক্ষতি হবে না। পতিভক্তি ঐ নারী স্বামীকে বাঁচাতে ছুটে যান ক্যাম্পে। সেখানে গিয়ে দেখেন, তার মত অনেক নারীকে আটকে রাখা হয়েছে। তাদের কাছে জানতে পারেন, সময়ে অসময়ে খান সেনারা তাদের ওপর ঝাঁপিড়ে চালায় নানা পাশবিক নির্যাতন। তার বেলাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। শত আকুতি মিনতি করেও তার কথা শুনেনি ওরা। ছেড়ে দেয়নি তার স্বামীকে। একাধারে ৪ রাত সেখানে বন্দী থেকে নানা নির্যাতন সহ্য করে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি পরে জানতে পারেন, তার স্বামীকে মেরে ফেলেছে ওরা।
জানা যায়, খান সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পীরগঞ্জ, রানীশংকৈল, হরিপুর উপজেলার কয়েক হাজার লোককে ধরে নিয়ে এসে রাণীশংকৈলের খুনিয়াদীঘি পাড়ের একটি শিমুল গাছের সাথে হাতের তালুতে লোহার পেরেক মেরে ঝুলিয়ে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে নানা নির্যাতন চালায়। পরে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দিত দীঘির পানিতে।
ঐ এলাকায় স্থাপিত সেনা ক্যাম্পে নারীর ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। এতে অনেকে অস্তসত্ত্বা হয়ে পড়েন। দেশ স্বাধীনের পর অনেকের কোলে জন্ম নেয় পিতৃ পরিচয়হীন অনেক সন্তান। যাদের আর পুনর্বাসন করা হয় নি। খুনিয়াদীঘির পাড়ে পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের নীরব স্বাক্ষী সেই শিমুল গাছটি এখন ডালপালা বিস্তার করে বিরাট আকার ধারণ করেছে। শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে ঐ পুকুর পাড়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী অফিসার এনামুল হক টেন্ডারের মাধ্যমে আরসিসি পিলার দিয়ে বাউন্ডারী ওয়াল গ্রীল সহ মোট ৯ লক্ষ টাকার কাজ সম্পন্ন করেছে।
এ ব্যাপারে গতকাল বৃহস্পতিবার মুঠোফোনে উপজেলা সহকারী কমিশনার ভুমি সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, জমিটি সরকারের দখলে নেওয়ার জন্য রংপুর বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে আপিল করা হয়েছে। ফাইলটি সেখানেই ঝুলে রয়েছে।
বর্তমান  উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী আফরিদার জানান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে ধরে রাখতে আধুনিক স্মৃতিসৌধ নির্মাণের লক্ষে উপজেলা প্রকৌশলীর মাধ্যমে ডিজাইন ও জায়গার পরিমাণ নির্ধারণ করে ফাইল জেলায় পাঠানো হয়েছে।
 
এবিএন/মোঃ মোবারক আলী/গালিব/জসিম
 

এই বিভাগের আরো সংবাদ