আজকের শিরোনাম :

অদম্য মেধাবীদের গল্প

দারিদ্রতা ওদের থামিয়ে রাখতে পারেনি

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৩ মে ২০১৮, ২০:৪৬

চিলমারী (কুড়িগ্রাম), ২৩ মে, এবিনিউজ : কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ১০ অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থী এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে চিলমারীবাসীকে তাক লাগিয়ে স্ব-স্ব দুঃখি পরিবারের মুখে এনে দিয়েছে সুখের হাসি।  দারিদ্রতা ওদের থামিয়ে রাখতে পারেনি। শিক্ষা জীবনে প্রথম সাফল্য ওদের এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়কে আরও দৃঢ় করেছে। তারপরও ভাল কলেজে ভর্তির সুযোগ নিয়ে ওরা হতাশাগ্রস্থ। এখন কি হবের তাদের ভবিষ্যৎ, কে যোগান দিবে তাদের উচ্চ শিক্ষার খরচ ? তা নিয়ে চিন্তিত এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর পরিবার।  

রিনা আক্তারঃ এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত শরীফের হাট এম ইউ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোছাঃ রিনা আক্তার। উপজেলার খরখরিয়া এলাকার মোঃ খোকা মিয়া ও আঞ্জুয়ারা বেগমের ৩য় কন্যা রিনা আক্তার। পিতা খোকা মিয়া নদীতে মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে যা উপার্জন করেন তাই দিয়ে কোন রকমে চলে রিনাদের সংসার। রিনার মা আঞ্জুয়ারা বেগম বলেন,তার ৬ ছেলে মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধি। প্রতিবন্ধি ছেলেসহ ৬সন্তানের ভরন-পোষন ও লেখা-পড়াসহ সাংসারিক খরচ বহন করতে হিসশিম খেতে হয়।তার পরও অনেকের সহযোগীতায় ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া চালিয়ে যাচ্ছি। রিনা ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়।

মোঃ সাকিব সরকারঃ পিতৃহারা মায়ের অভাবী সংসারের অভাবকে জয় করে ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত থানাহাট এ ইউ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোঃ সাকিব সরকার। পাশ্ববর্তী উপজেলার দক্ষিণ উমানন্দ জামিরবাড়ী গ্রামের মৃত রেজাউল সরকার ও গৃহিণী মোছাঃ শিউলি বেগমের ছেলে সাকিব সরকার। সাকিবের মা শিউলি বেগম বলেন, সাকিব যখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে তখন ওর বাবা মারা যায়। দুটি শিশু সন্তানকে নিয়ে অতি কষ্টে বিভিন্ন জনের সহায়তায় আমার ছেলের লেখা-পড়া চালিয়েছি। সাকিব ছাড়া ও আমার একটি মেয়ে ২য় শ্রেণীতে পড়ে। ছেলের লেখা-পড়ার জন্য পর্যাপ্ত ব্যয় করতে পারিনি। তার পরও ছেলের ভাল ফলাফলে তিনি অনেক খুশি। ছেলের ভাল ফলাফলে খুশির পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষার খরচ যোগান কিভাবে দিবেন  তা নিয়ে চিন্তিত সাকিবের-মা।

মনিরা খাতুন মনিঃ এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত শরীফের হাট এম ইউ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোছাঃ মনিরা খাতুন মনি। উপজেলার জোড়গাছ বাধ এলাকার ঘোড়ার গাড়ী চালক মোঃ এনামুল হক ও মোছাঃ বিউটি বেগমের ৪কন্যার মধ্যে ২য় কন্যা মনি। পিতা এনামুল হকের বাড়ী ভিটে ছাড়া স্থাবর-অস্থাবর কোন সম্পদ নেই। ঘোড়ার গাড়ীতে মাল বহন করে যা উপার্জন করেন তাই দিয়ে কোন রকমে চলে মনিদের সংসার। মনির মা বিউটি বেগম জানায়,তার ৪ মেয়ের মধ্যে বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। মেয়ের সংসার ভেঙ্গে যাওয়ায় সে মেয়েকেও এখন ভরনপোষন দিতে হচ্ছে। ৪সন্তানের ভরন-পোষন ও লেখা-পড়াসহ সাংসারিক খরচ বহন তাদের পক্ষে অসম্ভব প্রায়।তার পরও অনেকের সহযোগীতায় মেয়েদের লেখা-পড়া চালিয়ে যাচ্ছি। মনির উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত তার বাবা-মা।

মোঃ রাইজুল ইসলামঃ ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত বালাবাড়ীহাট বি এল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোঃ রাইজুল ইসলাম। পাশ্ববর্তী উপজেলার কাজলডাঙ্গা কানিপাড়া এলাকার মোঃ মঞ্জুরুল ইসলাম ও মোছাঃ রশিদা বেগমের ছেলে রাইজুল ইসলাম। রাইজুলের পিতা অন্যের অটোরিক্সা ভাড়ায় চালিয়ে যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে ৪ ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে কোন রকমে সংসার চালায়। অভাব অনটনের সংসারে ৪ সন্তানের লেখা-পড়ার ব্যয় মিঠানো রাইজুলের পিতার পক্ষে অনেকটাই কঠিন। ছেলের ভাল ফলাফলে খুশির পাশাপাশি উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চিন্তির তারা। রাইজুল লেখা-পড়া করে বড় প্রকৌশলী হতে চায়।

মোছাঃ শারমিন আক্তারঃ বাব-মায়ের অভাবী সংসারের অভাবকে জয় করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত শরীফের হাট এম ইউ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোছাঃ শারমিন আক্তার। উপজেলার পাত্রখাতা স্লুইচ গেট এলাকার মহিষের গাড়ী চালক মোঃ সিপন মিয়া ও মোছাঃ আর্জিনা বেগমের ৩সন্তানের মধ্যে ১ম কন্যা শারমিন আক্তার। পিতা সিপন মিয়া মহিষের গাড়ীতে মাল বহন করে যা উপার্জন করেন তাই দিয়ে কোন রকমে চলে শারমিনদের সংসার। শারমিনের মা আর্জিনা বেগম জানায়, অভাবের সংসার নিজেদের খাওয়া-পড়ার পাশাপাশি ৩ সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগান দেয়া তাদের সাধ্যের বাহিরে।তারপরও অতি কষ্টে সন্তানদের লেখা-পড়াসহ সাংসারিক খরচ বহন করে আসছেন তারা।মেয়ের ভাল ফলাফলে খুশির পাশাপাশি তাদের মাথায় পাহাড় সম চিন্তা ভর করেছে।

মোঃ জহুরুল ইসলামঃ অভাবকে জয় করে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে চিলমারীর জহুরুল ইসলাম। সে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত শরীফের হাট এম ইউ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পায়। উপজেলার জোড়গাছ নতুন বাজার এলাকার কৃষক মোঃ মুনছুর আলী ও মোছাঃ জেলেকা বেগমের কনিষ্ঠ পুত্র জহুরুল। ৪ ভাই-বোনের মধ্যে ১ভাই অটোরিক্সা চালিয়ে বৃদ্ধ পিতাসহ সংসারের ব্যয় বহন করে। পিতা ও পুত্র মিলে যা উপার্জন হয় তাই দিয়ে কোন রকমে চলে জহুরুলদের সংসার। জহুরুলের মা জেলেকা বেগম জানায়, ছেলের লেখা-পড়ার পিছনে তেমন ব্যয় করতে না পারলেও ছেলের ফলাফলে তিনি খুশি। ছেলের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিত্তবানদের সহযোগীতা কামনা করেছেন তিনি।

মোছাঃ আইরিন আক্তারঃ ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভকেশনাল ড্রেস মেকিং বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে আইরিন আক্তার। উপজেলার বহরেরভিটা এলাকার মাংস ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম ও গৃহিণী পারভিন বেগমের প্রথম কন্যা মোছাঃ আইরিন আক্তার। স্থাবর সম্পদ বলতে কিছুই নেই পিতার। বসতভিটার জায়গা টুকু ছাড়া আর কিছুই নেই। থানাহাট বাজারে খাসির মাংস বিক্রি করে ২মেয়ে ১ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে বসবাস করেন আমিনুল। সামান্য ব্যবসায় করে কোন রকমে দু’হাতের ওপর ভর করে সংসার চলে তার। সবসময়ই  নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। সামান্য আয়ে তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগানোর তেমন কোনো সাধ্য ছিল না বাবা আমিনুল ইসলামের। পরিবারের সাধ্য না থাকলেও আইরিনের ইচ্ছা লেখা-পড়া করে দেশের সেবা করবে সে।

মোছাঃ ইশিতা আক্তারঃ এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভকেশনাল ড্রেস মেকিং বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে ইশিতা আক্তার। উমানন্দ জঙ্গলতলা এলাকার কৃষক হামিদুল ইসলাম বাবলু ও গৃহিণী মাজেদা বেগমের ২য় কন্যা মোছাঃ ইশিতা আক্তার। ইশিতার বাবা ছিলেন পেষায় গাড়ীয়াল। আধুনিকতার যুগে গাড়ীর কদর কমে যাওয়ায় ওই পেশায় সংসার চলে না। বাধ্য হয়ে গাড়ী ছেড়ে কৃষি কাজে নাম লেখান তিনি। দু’হাতের উপার্জন দিয়ে সন্তানের লেখা-পড়াসহ সাংসারিক ব্যয় বহন তার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। সবসময়ই  নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। পরিবারের সাধ্য না থাকলেও ইশিতার ইচ্ছা লেখা-পড়া করে দেশের সেবা করবে সে।

মোছাঃ পারভিন আক্তারঃ অভাবকে জয় করে ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভকেশনাল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোছাঃ পারভিন আক্তার। দক্ষিণ উমানন্দ বংশিপাড়া এলাকার রিক্সা চালক মোঃ শহিদুল ইসলাম ও গৃহিণী মর্জিনা বেগমের ছোট কন্যা মোছাঃ পারভিন আক্তার। পারভিনের বাবা জোড়গাছ এলাকায় নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়ে বংশিপাড়া এলাকায় আশ্রয় নেয়। বর্তমানে ঢাকায় রিক্সা চালিয়ে যা উপার্জন করেন তাই দিয়ে তিনি তিন সন্তানের পড়া-লেখাসহ সংসার খরচ চালান। সন্তানদের লেখা-পড়া চালানোর সামর্থ না থাকলেও তাদের ভবিষ্যতের চিন্তায় অতি কষ্টে তা চালানোর চেষ্টা করেন। পরিবারের সাধ্য না থাকলেও পারভিনের ইচ্ছা লেখা-পড়া করে দেশের সেবা করবে সে।


মোছাঃ আরিফা আক্তারঃ এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে অবস্থিত থানাহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভকেশনাল শাখায় জিপিএ-৫ পেয়েছে মোছাঃ আরিফা আক্তার। উপজেলার মুদাফৎথানা সরকারপাড়া এলাকার পেশায় কাঠ মিস্ত্রি মোঃ টিটুল মিয়া ও শিরিনা বেগমের বড় মেয়ে আরিফা আক্তার। পিতার মিস্ত্রি কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কোন রকমে চলে আরিফাদের সংসার। আরিফার মা শিরিনা বেগম বলেন, একজনের সামান্য আয় দিয়ে সংসার ও তিন সন্তানের লেখা-পড়ার ব্যয় বহন করতে হয়। তার পরও অনেকের সহযোগীতায় ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া চালিয়ে যাচ্ছি। মেয়ের উচ্চ শিক্ষায় বিত্তবানদের সহযোগীতা কামনা করেন তিনি।

এবিএন/গোলাম মাহবুব/জসিম/রাজ্জাক

এই বিভাগের আরো সংবাদ