আজকের শিরোনাম :

রুমায় বালু উত্তোলনের মহোৎসব : পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৪৩

সরকারী নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় সাংগু নদীর পাড়ে চলছে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন ও বিক্রি।  এতে ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকির মুখে পড়েছে নদীর তীরবর্তী এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য ও ব্যক্তি মালিনাধীন আবাদি ফসলি জমিগুলো। অবাধে বালু উত্তোলন করে একদিকে ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে লক্ষ টাকা, অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে মোটা অংকের রাজস্ব।

এ অবস্থায় বন্ধের পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে অবৈধ বালু উত্তোলন ও বিক্রি। রুমা সদর ইউনিয়নের মুনলাই পাড়া এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় সাংগু নদীর পাড়ে কয়েকজন শ্রমিক স্তুপকৃত বালু দুইটি ট্রাকে উঠাচ্ছে। শ্রমিকদের কাছে মালিকের খোঁজ নিলে তারা জানায় ঠিকাদার মোহাম্মদ ইমরান, তার সাথে আছে স্থানীয় নেতা মাবুদ।

 আরো জানা যায় অনেকদিন ধরে সেখানে কাজ করছে তারা, প্রতিদিন দুই-তিনটি ট্রাকে বালু ভর্তি করে ১৫ থেকে ২০ বার বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যায় তারা। প্রতি ট্রাকে ভালো লোড দিলে ২০০ ফুট পর্যন্ত বালু নেয়া যায় বলে জানালো তারা। সে স্থান থেকে ৫০০ ফিট পেছনে রুমা খালের মোহনায় চড় খননের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের আরেকটি জায়গার দেখা মিলে। এ জায়গটির মালিক ক্রয়সূত্রে মংশৈসিং মারমা ওরফে মিলটন।

 এ  চড়টির আয়তন দেড় একর, মিলটন যৌথ ভাবে ঠিকাদার বাথোয়াইচিং মারমার সাথে বালু উত্তোলন করে ব্যবসা করছে। জানা যায় একই প্লটে তিনটি দল বালু উত্তোলন করে ব্যবসা জমিয়েছে। আবার তাদের পাশের প্লট থেকে বালু উত্তোলন করেন বান্দরবানের ব্যবসায়ী মফিজুর ভুট্টো। এ প্রতিবেদক সরেজমিনে সেখানে অবস্থান কালে এক্সকাভেটর দিয়ে নদীর ধার থেকে খনন করে বালু উত্তোলনের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। ছবি তুলতে দেখে এক্সকাভেটর থেকে নেমে সটকে পড়েন এক শ্রমিক, তাই কোন কথা বলা যায়নি।

থানা পাড়া ঘাটের উপরে ঠিকাদার মোহম্মদ হারিছ ও রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইউজিন ত্রিপুরা ওরফে মেস্তরাম প্রভাব খাটিয়ে জোড় পূর্বক ব্যক্তি মালানাধীন জায়গার ক্ষতিসাধন করে দীর্ঘদিন যাবত বালু উত্তোলন করে আসছেন। অবৈধ এক্সকাভেটর ও ড্রেজার দিয়ে প্রায় অর্ধ শত শ্রমিক লাগিয়ে বালু উত্তোলন করে অবাধে অবৈধ ব্যবসা করে যাচ্ছেন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা।

 ২০১৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সাংগু নদীর পারে এসব চড় এলাকায় বালু উত্তোলন শুরু হয়। বাইরে থেকে আসা প্রভাবশালী ঠিকাদার ব্যবসায়ীরা ওই সময় স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কাজে লাগিয়ে বালু উত্তোলন শুরু করে। চলতি বছর বর্ষার সময় তিন মাস বালু উত্তোলন বন্ধ ছিল, এরপর আবার শুরু অবাধে উত্তোলন। বিগত বছরের তুলনায় এ বছর বেড়েছে একটি বালু দস্যু চক্রের নেতৃত্বে অবৈধ বালু উত্তোলনের মহোৎসব।
বালু ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে অবৈধ বালু উত্তোলনকে নির্বিঘœ করতে প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সাংবাদিকদের ম্যানেজ করতে বালু ব্যবসায়ীরা প্রতি গ্রুপ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে মোট ছয়টি গ্রুপে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা  জমা করেছে।

এর মধ্যে স্থানীয় ঠিকাদার বিপ্লব মারমা বিভিন্ন জায়গায় ম্যানেজের কথা বলে মোট টাকা থেকে ১ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা পকেটস্থ করে নিয়েছে। ফলে বিশ^াসযোগ্য কোন টাকার হিসাব দিতে না পারায় নিজেদের মধ্যে দেখা দিয়েছে দন্ড। এ ব্যাপারে তার কাছে জানতে চাইলে নানা কথা বলে টাকার বিষয়টি এড়িয়ে গেলেও সরাসরি অস্বীকার করেননি তিনি।

 বিষয়টি মোহাম্মদ ইমরান সহ কয়েকজন বালু ব্যবসায়ীর কাছে জানতে চাইলে তারা জানান তাদের অংশ অর্থাৎ ৩০ হাজার টাকা প্রশাসন, পুলিশ ও সাংবাদিকদের দেওয়ার জন্য বিপ্লবের কাছে জমা দিয়েছেন বলে জানান তারা। তারা আরো জানান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ঘুষ খান না বলে বালু ব্যবসায়ীরা বেকায়দায় পড়েছেন। তবে এ কাজ কেও থামাতে পারবেনা বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে তারা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা মোহাম্মদ শামসুল আলম সরকারী কাজে উপজেলার বাইরে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
রুমা উপজেলার কোথাও অনুমোদিত বালু মহাল নেই এবং নদী হতে বালু উত্তোলনের নেই স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতিও। তারপরও প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে সাংগু নদীর বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় আটটি পয়েন্টে বালু উত্তোলন করে চলছে বিশাল অবৈধ ব্যবসা। নদী এবং পানি প্রবাহের উৎস হতে বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে যথাযথ ঢাল সংরক্ষণ সাপেক্ষে সুইং করে নদীর তলদেশ সুষম স্তরে যাতে খনন করা যায় সেরূপ ড্রেজার ব্যবহার পূর্বক বালু উত্তোলন কার্যক্রম পরিচালনা করার সরকারী বিধি থাকলেও উত্তোলনকারীরা এসবের কিছুই জানেন না, মানবেন তো দূরের কথা।

 পরিকল্পনাহীন এভাবে যত্রতত্র বালু লুটের কারণে জীব বৈচিত্র তথা মাছের স্বাভাবিক জীবন চক্রে ব্যাঘাট ঘটা, ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট ভেঙ্গে পড়া, নদীর পাড়ের মাটি আলগা হয়ে নদীর উপর ব্রিজ বা সেতুর জন্য ঝুঁকি তৈরি হওয়া, ফসলি জমির ক্ষতি সহ নানাবিধ ক্ষতি সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

 ইতিমধ্যেই এ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের বাকবিতন্ডার ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত জমির মালিকদের সাথে মেস্তরাম ত্রিপুরার হাতাহাতির ঘটনা ঘটে, পরে থানা পুলিশের হস্তক্ষেপে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ জন জমির মালিককে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হন মেস্তরাম ত্রিপুরা।

 ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিপ ত্রিপুরা ও প্রশান্ত বাহাদুর অভিযোগ করেছেন, এ জমিতে বালু উত্তোলনের জন্য আবারো এক্সকাভেটর এনে রেখেছে ঠিকাদার মোহম্মদ হারিছ।
এভাবে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনে ভয়াবহ নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ছে, হুমকির মুখে পড়েছেন নদী তীরবর্তী ঘরবাড়ী ও আবাদী জমির মালিকেরা।

 কিন্তু এখনো বালু উত্তোলন বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই। এ ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন সহ আইন প্রযোগকারী সংস্থার কর্তাদের নজরদারীর পাশাপাশি যথাযথ ভুমিকা রাখা অতি জরুরী বলে মনে করেন স্থানীয় এলাকাবাসী।

বালু উত্তোলনের বৈধতা প্রসঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান অংথৈায়াইচিং মারাম এর নিকট জানা যায় বালু উত্তোলনে রুমা উপজেলায় সরকার অনুমোদিত কোন প্রকার বালু মহল নেই কাজেই প্রশাসনের অনুমোদন থাকার প্রশ্নই ওঠেনা। তার কাছে আরো জানা যায় যে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বালু উত্তোলনকারীদের ডেকে সতর্ক করা হয়েছিলো।

 

এবিএন/চনুমং মারমা/জসিম/তোহা

এই বিভাগের আরো সংবাদ