আজকের শিরোনাম :

পাহাড় ধ্বসে ১৭ বছরে ২১৩ জনের প্রাণহাণি

চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদে নেমেছে জেলা প্রশাসন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ মে ২০১৮, ২০:২৫

চট্টগ্রাম, ২০ মে, এবিনিউজ : চট্টগ্রামে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে টানা বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে ও মাটি চাপায় অনাকাঙ্খিত মৃত্যুবরণ করে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষরা। বর্ষা আসার মাস দু মাস আগে দুর্ঘটনা এবং মৃত্যু ঠেকাতে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ, গ্যাস-পানি, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তবে সরকারদলীয় নেতা ও প্রভাবশালীরা এসব অবৈধ বসতির নিয়ন্ত্রণে থাকায় পুরোপুরি সফল হতে পারে না প্রশাসন।

বর্তমান সময়ের অন্যান্য স্থানের তুলনায় অনেক কম টাকা বাসা ভাড়া পেয়ে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এসব খুপরিতে থাকছে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। ফলে প্রতিবছরের ন্যায় এবারও মৃত্যুঝুঁকির আশংকা থেকে বর্ষার আগেই উদ্দ্যোগ গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্টরা।

ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে পাহাড়ে বসবাসরত অবৈধ বসতিদের উচ্ছেদ ও নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনার জন্য জেলা প্রশাসনের এক মাসের বেঁধে দেওয়া সময়ে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। চলতি বছরের গত ১১ এপ্রিল থেকে চলছে এ অভিযান। তবে প্রথমদিনে লালখান বাজার মতির্ঝণা পাহাড়ে উচ্ছেদে গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে বাধা দিয়েছিল স্থানীয় লোকজন।

১২ এপ্রিল বায়েজিদ থানার মিয়ার পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে নির্মাণকৃত ৫০ ঘর উচ্ছেদ করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। সেদিন ওই এলাকার ১৫০ ঘর থেকে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল। এরপর প্রায় ৩৮ দিন পর দ্বিতীয় দফায় চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ এলাকার অবৈধ বসতি উচ্ছেদের মাধ্যমে পুনরায় শুরু হয় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অভিযান।

রবিবার সকালে কোতোয়ালি সার্কেলের সহকারী কমিশনার শেখ জোবাইর আহমেদের নেতৃত্বে পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকা বেশ কয়েকটি ঘরের স্থাপনা ভেঙে দেয়ার পাশাপাশি কয়েকটি ঘরের বিদ্যুৎ সংযোগও বিছিন্ন করা হয়।

এসময় সহকারী কমিশনার (ভূমি) জোবাইর আহমেদ জানান, আকবর শাহ এলাকায় ৮-১০টি পাহাড়ে এক থেকে দেড়শ ঝুঁকিপূর্ণ ঘর আছে। সবগুলো অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা রয়েছে। রবিবার সকাল ১০ টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত চলমান অভিযানে ঝুকিপূর্ন প্রায় অর্ধশতাধিক অবৈধ বসতঘর উচ্ছেদ করা হয়। পাহাড় ধ্বসে প্রাণহানি ঠেকাতে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন এসি ল্যান্ড জোবাইর আহমেদ।

অভিযানে পুলিশ, আনসার সদস্যরাসহ কেজিডিসিএল, পিডিবি, চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তা কর্মচারীরা সহযোগিতা করেন। এর আগে মাইকিং করে অবৈধ স্থাপনা ও বসতঘর সরিয়ে নিতে প্রচারণা চালানো হয়।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, মিয়ার পাহাড়, এ কে খান পাহাড়, আমিন টেক্সটাইল মিল পাহাড়কে অগ্রাধিকার দিয়ে পাহাড় পাদদেশে অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বসবাসকারীদের এক মাসের মধ্যে উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসককে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অনুরোধ করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াছ হোসেন। তিনি গত ১৪ মে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ দিয়েছেন।

এদের মধ্যে কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শেখ জোবায়ের আহম্মেদ, পতেঙ্গা সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. জিয়াউল হক মীর, সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল মনসুর, আগ্রাবাদ সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শারমীন আখতার, বাকলিয়া সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাবরিনা মুস্তাফা এবং চান্দগাঁও সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. সাব্বির রহমান সানি। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ছাড়াও মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ কমিশনার, সিডিএ চেয়ারম্যান, রেলওয়ে, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ওয়াসা, র‌্যাব৭, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, কর্ণফুলী গ্যাস সিস্টেমস লি. ও ফায়ার সার্ভিসকে উচ্ছেদ অভিযানে সহযোগী করার জন্য অনুরোধ জানানো হয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, গত ১১ এপ্রিল থেকে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে অবৈধ বসতি উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও রবিবার থেকে পুরোদমে শুরু হয় উচ্ছেদ কার্যক্রম। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পাহাড়ে তৈরি বসতিগুলোতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কোন হোল্ডিং নাম্বার না থাকা স্বর্ত্তেও গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং পানির সংযোগ পাওয়ায় উচ্ছেদ অভিযানে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।  তিনি উচ্ছেদের বিষয়ে শুধু চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন নয়, সবগুলো সংস্থাকেই একসাথে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

 

চট্টগ্রামে পাহাড় ধ্বসে ১৭ বছরে ২১৩ জনের প্রাণহাণি :  
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, গত ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে পাহাড় ধ্বসে ২১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬ জনের প্রাণহাণির ঘটনা শুধু চট্টগ্রাম শহরেই ঘটেছে।  সূত্র মতে জানা যায়, চট্টগ্রামের সিআরবি পাহাড়ের একাংশের সীমানা প্রাচীরসহ পাহাড় ধসে মারা ১০ জন লোকের মৃত্যু ঘটেছিল ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট। পরের বছর ১৩ জন মারা যায় নগরীসহ চবি ক্যাম্পাসের আবাসিক এলাকার পাহাড় ধসে। এরপর উল্লেখযোগ্য কোন প্রাণহানির গটনা না ঘটলেও ২০০৭ সালের ১১ জুন নগরীর সাত স্থানে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়। পরের বছর ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট পাহাড় ধসে ১১ জনের মৃত্যু ঘটে মতিঝর্ণা পাহাড়ে।

২০১১ সালের ১ জুলাই বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেওয়াল ধসে ১৭ জন, ২০১২ সালের ২৬ জুন নগরীর ৪ স্থানে পাহাড় ধসে ১৮ জন, ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি খুলশী থানার ইস্পাহানি গোলপাহাড় ধসে একজন, ২৮ জুলাই লালখান বাজারের টাংকির পাহাড় ধসে দুইজন নিহতের ঘটনা ঘটে।  এছাড়া ২০১৪ সালের ১৮ জুলাই ঈদ-উল-ফিতরের রাতে দুই স্থানে পাহাড় ও দেয়াল ধসে পাঁচ শিশুসহ ছয়জন এবং ২০১৫ সালের ১৯ জুলাই এবং ২১ সেপ্টেম্বর পাহাড় ধসে ৮ জনের মৃত্যু ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে।

 

চট্টগ্রামের পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ ৩০ পাহাড় :
চট্টগ্রাম শহরে ২৮টি এবং সীতাকুণ্ডের ২টিসহ সর্বমোট ৩০টি পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণভাবে চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। পাহাড়গুলোতে প্রভাবশালীদের সহায়তায় নিম্ন আয়ের লোকজন অবৈধভাবে বসতি গড়ে তোলে। অল্প টাকার ভাড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বহু লোক এখানে বসবাস করে। প্রতি বছরই চট্টগ্রামে পাহাড় ও মাটি ধসে বিভিন্ন এলাকায় লোকজন মারা যায়। ঝুঁকি পূর্ণ পাহাড়গুলোর মধ্যে ১৬টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে ৬৮৪ পরিবারে তিন হাজার ৪৯১ জন বসবাস করার তথ্য রয়েছে জেলা প্রশাসনে।

৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের মধ্যে রয়েছে সিআরবি পাহাড়ের পাদদেশ, টাইগারপাস-লালখান বাজার রোড সংলগ্ন পাহাড়, টাইগারপাস মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ, মোজাফফর নগর পাহাড়, কাট্টলি থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত পাহাড়, সলিমপুর বাস্তুহারা পাহাড়, প্রবর্তক পাহাড়, গোলপাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড়, বন গবেষণাগার ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, জয়পাহাড়, চট্টেশ্বরী হিল, মতি ঝর্ণা ও বাটালি হিল সংলগ্ন পাহাড়, রেলওয়ে এমপ্লয়িজ গার্লস স্কুল সংলগ্ন পাহাড়, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা পাহাড়, জালালাবাদ হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, গরীবুল্লাহ শাহ মাজারের পাশের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটি সংলগ্ন পাহাড়, ডিসি হিলের চেরাগী পাহাড়ের দিকের ফুলের দোকানের অংশ, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি কর্পোরেশনের পাহাড়, এ কে খান অ্যান্ড কোং পাহাড়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন পাহাড়, কৈবল্যধামের বিশ্ব কলোনির পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, লালখান বাজার চান্দমারি রোড সংলগ্ন জামেয়াতুল উলুম ইসলামি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের পাহাড়, ফরেস্ট রিচার্চ ইনস্টিটিউট একাডেমির উত্তর পাশের মীর মোহাম্মদ হাসানের মালিকানাধীন পাহাড়, ইস্পাহানি পাহাড় সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের হারুন খানের মালিকানাধীন পাহাড়ের পশ্চিমাংশ, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, লেক সিটি আবাসিক এলাকার পাহাড় ও সিডিএ অ্যাভিনিউ রোডের পাশে অবস্থিত ব্লোসম গার্ডেন সংলগ্ন পাহাড়। এসব পাহাড়ের কয়েকজন ব্যক্তি পাহাড় কেটে এসব অবৈধ বসতি নির্মাণ করেছেন।

এবিএন/রাজীব সেন প্রিন্স/জসিম/রাজ্জাক

এই বিভাগের আরো সংবাদ