আজকের শিরোনাম :

নিকলীতে পাঁচ জয়িতার উন্নয়নের বাতিঘর

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২১, ১৬:২৩

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় জয়িতা ২০২০ সালে পুরস্কারে ভূষিত হলেন কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার পাঁচ সূর্য কন্যা। জয়িতারা উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক। নিজেরদের প্রতিকূলতাকে ঝয় করে এবং অদ্যম ইচ্ছা শক্তিকে সম্বল করে নারী উন্নয়নে সমাজে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তারা। নিকলী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কার্যালয় পাঁচটি ক্যাটাগরিতে এসব জয়িতা নারীদের নির্বাচিত করে পুরস্কারে ভূষিত করেছেন।

যেসব ক্যাটাগরিতে জয়িতাদের পুরস্কার ভূষিত করেছেন- (১) অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী, (২) শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী, (৩) সফল জননী নারী, (৪) নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী (৫) সমাজ উন্নয়নের অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী :  আকলিমা আক্তার, স্বামী- মোঃ হান্নান, মাতা- লিলিয়া আক্তার, গ্রাম- নোয়াপাড়া, ইউনিয়ন- দামপাড়া, উপজেলা-নিকলী, জেলা- কিশোরগঞ্জ বেকার স্বামীর কাছে অল্প বয়সে বিবাহ দেওয়ার কারণে সংসার ভাল যাচ্ছিল না। তিনি চিন্তা করেন নিজে কিছু একটা করে নিজে এবং স্বামীকে কাজে লাগানো যায়।

এর মধ্যে তার একটি সন্তান হয। এতে সঙসারের খরচ আরো বেড়ে যায়। স্বামীর কোন কাজ না থাকায় এবং সংসারে কোন আয়-রোজগার না থাকায় সংসারে দিন দিন অবাব অনটন বেড়েও চলছিল। তিনি একটি এনজিও থেকে ৬০০০/- টাকা ঋণ নিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনেন। পরবর্তীতে তিনি দামপাড়া বাজারে একটি মুদির দোকান দেন। দোকান থেকে মাসে প্রায় ১৫,০০০/- টাকা আয় করেন। তিনি বাড়ির আঙ্গিনায় শাক-সবজী চাষ, হাঁস-মুরগি পালন করেন। বর্তমানে তাদের প্রতিমাসে আয় প্রায় ২৫,০০০/- টাকা। তিনি এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী : মোহাছানা, পিতা- মোঃ আসাদ, মাতা- শিরিষা, গ্রাম- দামপাড়া, ইউনিয়ন- দামপাড়া, উপজেলা- নিকলী, জেলা- কিশোরগঞ্জ তিনি এইচ এস সি পাস করার পর তাকে ৯/৩/২০১৮ তারিখে বিয়ে দেওয়া হয়। তিনি লেখাপড়ার করার ইচ্ছা থাকা সত্বেও বাবার অভাব অনটনের সংসারে লেখাপড়া আর করা হয়নি। তার অমতেই একজন বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে দেয়। স্বামীর সংসারে গিয়ে আরো বেশী অভাবে পড়েন। বিয়ের ১ বছর পর থেকে তার স্বামী যৌতুকের জন্য চাপ প্রয়োগ করে।

এক পর্যায়ে তাকে শারিরীক ও মানসিকভাবে নির্যাতন শুরু করে। তার স্বামীর অত্যাচারে অতীষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে বাবার বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয়।স্বামীর অত্যাচারে বাবার বাড়ি এসে তিনি স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন। তিনি সেলাইয়ের কাজ জানতেন, তিনি একটি সেলাই মেশিন কিনেন। তিনি তার বাবার বাড়ির আশে-পাশের লোকজনের কাপড় সেলাই করে মুটামুটি ভাল আয়-রোজগার করতে থাকেন। তিনি ইতোমধ্যে আরো কয়েকজন মহিলাকে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।

তিনি আরো দু‘টি সেলাই মেশিন কিনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মহিলাদের মাধ্যমে সেলাইয়ের কাজ বৃদ্ধি করেন। তিনি তার বাবার বাড়িতে একটি কাপড়ের দোকান দেন।এতে তিনি বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী। তার আয়-রোজগারে নিজে এবং বাবার সংসার ভালভাবে চলছে। সমাজ উন্নয়নের অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী: মোছাঃ লুৎফুন্নেছা, স্বামী- মোঃ রৌশন ইজদানী, মাতা- মোছাঃ হানিফা, গ্রাম- উত্তর দামপাড়া, পোঃ দামপাড়া, উপজেলা- নিকলী, জেলা- কিশোরগঞ্জ তিনি ২০১৬ সালে দামপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত  মহিলা আসনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। তিনি ছোট বেলা থেকেই নিজেকে জনগনের সেবা করার জন্য ইচ্ছাপোষন করেন। তার সেই ইচ্ছা থেকেই সংরক্ষিত মহিলা সদস্য আসনে প্রতিদ্বদ্ধিতা করেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রতিদ্বন্ধিতা করে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। পরিষদের সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়ে এলাকার ড্রেইন, কালভাট, রাস্তা, ঘাটলা, টিউবওয়ের ইত্যাদি এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। দরিদ্র মহিলাদের মাঝে স্যানিটারি ন্যাপকিন, সেলাই মেশিন বিতরন করেছেন। ইউনিয়নের ওয়ার্ডসভা ও সচেতনতা মূলক উঠান বৈঠকের মাধ্যমে বাল্য বিবাহ, পারিবারিক বিরোধ নিরস ও যৌতুক প্রথা বিরুদ্ধে সোচ্ছার আছেন।

তার কর্মক্ষমহীন স্বামীর সংসারে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন। সমাজ উন্নয়নে তিনি রাত দিন কঠোর পরিশ্রম করে যাছেন। সফল জননী নারী: রোহেনা বেগম, স্বামী- আবু হানিফ, মাতা- আরজুদা বানু, গ্রাম- গোবিন্দপুর, পোঃ নিকলী, উপজেলা- নিকলী, জেলা- কিশোরগঞ্জ স্বামী ছোট-খাট ব্যবসা করেন। ব্যবসায় যা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে। ৬জন ছেলে মেয়ে নিয়ে অভাব অনটনে দিন কাটাতে হয়েছে। সবকটি ছেলেমেয়েকে স্কুল কলেজে লেখাপড়া করানো তার স্বামীর একার পক্ষে খুব কষ্টে দিন যাপন করতে হয়েছে। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি। অভাব অনটনের মধ্যে সকল সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়েছেন। তার ঐকান্তির প্রচেষ্টায় এবং অদম্য সাহসিকতায় সকল সন্তাদের লেখাপড়া প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন।

অভাব অনটনের কারণে বিভিন্ন সময় সামাজিকভাবে  অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে। ১ম সন্তান সুকেনা বেগম, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করে করে বর্তমানে ষাইটধার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ২য় সন্তান সানজিদা আক্তার, কিশোরগঞ্জ  সরকারী মহিলা কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করে বর্তমানে আঠারবাড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ৩য় সন্তান রাসেল কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ থেকে এম. এস. সি পাস করে প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। ৪র্থ সন্তান নাফিজা ইসরাত, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করে বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে পুলিশ সার্জেন্ট হিসাবে কর্মরত আছেন। ৫ম সন্তান আফরাফুল আরমান, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ থেকে অনার্স তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়ন রত। ৬ষ্ট সন্তান সাদমান রাতিন, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে অনার্সে প্রথম বর্ষ ছাত্র। শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী: আফরিনা আক্তার, পিতা- ইন্নছ আলী, মাতা- আফরোজা বেগম, গ্রাম- নয়াহাটি, পোঃ নিকলী, উপজেলা- নিকলী, জেলা- কিশোরগঞ্জ বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না।

ফলে লেখাপড়ার খরচ চালাতে না পেরে অল্প বয়সে পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে দিয়ে দেয়। অল্প বয়সে বিষে দিয়ে দেওয়ায় লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তার ইচ্ছা ছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। বেকার স্বামী থাকায় পরিবারে তার কোন মর্যাদা ছিল না। স্বামীর বাড়ী যৌথ পরিবারে সাংসারিক সকল কাজ তাকে করতে হতো। স্বামীর বাড়ীর লোকজন তাকে শারিরীক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতো। দাম্পত্য জীবনে কোন সুখ ছিল না।

বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল না থাকায় ভাই বোনদের নিয়ে বাবা হিমশিত অবস্থা। কোনো উপায় না পেয়ে তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। এস এস সি পাস করার পর তিনি আনন্দ স্কুলের শিক্ষকতা, কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে, বয়স্ক শিক্ষা অফিসে শিক্ষকতা করে লেখাপড়ার খরচ যোগারসহ সংসারের কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করে। একই সাথে তিনি লেখাপড়া চালিয়ে এইচ, এস. সি ও স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন কেরন। বর্তমানে তিনি ব্রাক অফিসে একাউন্টস অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। চাকুরী করে তিনি বর্তমানে স্বামীর সংসারে আর্থিক সফলতা লাভ করেন।
 

এবিএন/জয়দেব আচার্য্য/জসিম/তোহা

এই বিভাগের আরো সংবাদ