আজকের শিরোনাম :

বিবিসি বাংলার বিশ্লেষণ

শীর্ষ র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় নেই কেন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ১১:৩৮

বাংলাদেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল অঙ্কের উন্নয়ন বাজেটও রাখছে সরকার।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে আন্তর্জাতিক যে র‌্যাংকিং সেখানে প্রথম এক হাজারের মধ্যেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই।

ফলে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসলে শিক্ষা-গবেষণাসহ নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কাজ কতটা হচ্ছে?

বাস্তব পরিস্থিতিটা কেমন তাই দেখতে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক গিয়েছিলেন সিরাজগঞ্জ জেলায়।

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে মহিলা ডিগ্রী কলেজে গিয়ে দেখা গেল, পাশাপাশি রয়েছে ৩টি ভবন। এর একটিতে শোভা পাচ্ছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড। মূলত চারতলা এই ভবনটিতেই আংশিকভাবে চলছে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এই মহিলা ডিগ্রী কলেজ ছাড়াও শাহজাদপুরেরই আরও ২টি কলেজের ২টি ভবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরিচালিত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। ক্লাস রুম, লাইব্রেরি, প্রশাসনিক ভবন সব কিছুই ছড়ানো ছিটানো।

ভবনটির একটি শ্রেণিকক্ষে দেখা গেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের জনাবিশেক শিক্ষার্থী বেশ কিছু প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে কাজ করছেন, যেগুলো সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে বিভিন্ন পুরনো স্থাপনার মাটি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলো হাজার বছরের পুরনো একটি প্রাচীন জনপদের সন্ধান দিতে পারে- এমন ধারণা থেকেই বিভাগের পক্ষ থেকে গবেষণাটি পরিচালিত হচ্ছে।

নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কার্যক্রম চলছে কেমন? জানতে চাইলে বিভাগটির চেয়ারম্যান তানভীর আহমেদ জানান, নতুন এই গবেষণা নিয়ে উৎসাহের কমতি নেই। কিন্তু প্রতিবন্ধকতাও অনেক। প্রথমত, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি দরকার, আমাদের তা নেই। দ্বিতীয়ত, কার্বন ডেটিংয়ের মাধ্যমে কোনো প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের সময় বের করার কাজ অনেক ব্যয়বহুল। আমাদের জন্য সেটা অনেক বড় সমস্যা।

এ ছাড়া আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য প্রস্তুত করাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। যেহেতু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়, নতুন বিভাগ। অবকাঠামো নেই। ফলে সমস্যা তো হচ্ছেই।

ক্যাম্পাস নেই
তবে এর চেয়েও বড় সমস্যা আছে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও নিজস্ব কোনো ক্যাম্পাস নেই। তবে ইতোমধ্যেই দুটি সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। ছেলেদের কোনো হল নেই। নিজস্ব খেলার মাঠ নেই। লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বইও নেই। শ্রেণিকক্ষের সংখ্যাও অপ্রতুল।

১০০ একর জায়গা বরাদ্দ হলেও কবে প্রকল্প অনুমোদন পাবে আর কবে নির্মাণকাজ শুরু হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া হচ্ছে।

অনেক প্রশ্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে
বাংলাদেশে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গত ১০ বছরে চালু হয়েছে ১৪টি। নিজস্ব ক্যাম্পাস না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে এসবের কোন কোনটি যেমন শিক্ষা ও গবেষণায় হিমশিম খাচ্ছে, তেমনি পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার আন্তর্জাতিক মান কতটা অর্জন হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

বিশেষ করে বৈশ্বিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিং- সেখানে প্রথম এক হাজারের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্থান না হওয়ায় তুমুল সমালোচনা হচ্ছে সবখানে।

এমনকি ২০১৬ সালে র‍্যাংকিংয়ে ৬০০ প্লাস অবস্থানে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানও এবার হাজারের বাইরে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ অবশ্য বলছেন, বিশ্বের হাই র‍্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যা খরচ করে এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যেভাবে তা আদায় করে সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্ভব নয়। এখানকার আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত সব কিছুই অন্যরকম। তা ছাড়া এখানকার শিক্ষকরা তাদের গবেষণা অনলাইনে হালনাগাদ করেন না। সব কিছু মিলিয়েই এর একটা প্রভাব র‍্যাংকিংয়ে আছে।

তবে র‍্যাংকিং নিয়ে প্রশ্ন তুললেও এই শিক্ষক অবশ্য অকপটেই স্বীকার করছেন, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার মান ও গবেষণায় উন্নতি না হয়ে বরং অবনতি হয়েছে।

তিনি বলছেন, ‘এখানে শিক্ষকদের অধ্যাপক হওয়ার জন্য মিনিমাম কয়েকটা গবেষণা থাকতে হয়। দেখা যায় অধিকাংশ শিক্ষক শুধু সে কয়েকটা গবেষণা শেষ করেই ক্ষ্যান্ত দেন। এরপর আর নতুন গবেষণায় নিয়োজিত হন না। অনেক ডিপার্টমেন্টেই এখন আর মাস্টার্সে শিক্ষার্থীদের থিসিস হচ্ছে না। এগুলো সত্য ঘটনা। এসব ঘটছে।’

তাহলে এর জন্য দায় কার? এমন প্রশ্নে নাসরীন আহমাদের উত্তর ‘এর দায় আমাদের। আমাদের শিক্ষকদের। আমরাই গবেষণায় সময় না দিয়ে সেটা অন্য কাজে ব্যয় করছি। এবং আমাদের জবাবদিহিতাও নেই।’

শিক্ষা নয়, আলোচনার বিষয় হয়েছে দুর্নীতি
বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নয়নে গত ৯ বছরে বাজেট বাড়িয়েছে সরকার। গবেষণাতেও বেড়েছে বরাদ্দ। সর্বশেষ অর্থ বছরে শুধু উন্নয়ন বাজেটই রাখা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা নয়, বরং দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিতর্কে আলোচনায় এসেছে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়।

বলা হচ্ছে, শিক্ষা নয়, রাজনীতিই এখন মুখ্য হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। রাজনৈতিক প্রভাবেও জবাবদিহিতা কমে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ আব্দুল মান্নান চৌধুরীও তেমনটাই মনে করেন।

তিনি বলছেন, ‘শিক্ষাঙ্গনে এখন অপরাজনীতি ঢুকে গেছে। বলা হয় যে, যতটা না শিক্ষক তার চেয়ে বেশি ভোটার নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। অধ্যাপকরা গবেষণার চেয়ে রাজনীতির পথ বেয়ে তরতর করে উপরে উঠার চেষ্টা করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আসলে গবেষণার পরিবেশ নেই।’

এবিএন/সাদিক/জসিম

এই বিভাগের আরো সংবাদ