আজকের শিরোনাম :

সায়েন্টিফিক বিযিনেস্

  আবুল মনসুর আহমদ

১৪ জুলাই ২০২০, ২১:০৩ | আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২০, ২১:৫৭ | অনলাইন সংস্করণ


বাংগালী জাতটা ছিল একটা প্রতিভাশালী জাত। তবে তাদের দোষের মধ্যে মস্ত দোষ ছিল, তারা চাকরি ছাড়া আর কিছু বুঝত না। তেজারতি ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে তাদের খেয়াল ছিল না মোটেই। তারা চাঁদা করে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ত। সেক্স্পিয়ার মিল্টন মুখস্থ করে বি.এ.এম.এ. ডিগ্রি নিত। তারপর ত্রিশ টাকা মাইনের কেরানিগিরি পেত। তাও যদি নিতান্ত না জুট্ত, তবে ওকালতির গাউন কাঁধে নিয়ে আদালতের বারান্দায় পায়চারি করত। আর ভাই-এ ভাই-এ ঝগড়া বাধিয়ে বেড়াত। অথবা ডাক্তারির সনদ নিয়ে বাড়তি লোক নিকেশ করত। এতেও হাতসাফাই দেখাতে না পারলে অগত্যা ছেলে-মেয়েদের সেকস্পিয়ার-মিল্টন পড়িয়ে তাদের ভবিষ্যৎ নিজেদের মতই ঝরঝরে করবার চেষ্টা করত অর্থাৎ মাস্টারি করত। 

ওদিকে ভাটিয়ে মাড়োয়ারী সিন্ধী ইস্পাহানী দিল্লীওয়ালা ও বোম্বাইওয়ালারা দলে-দলে বাংলায় এসে দেশের সমস্ত তেজারতি দখল করল। বাংলার রাজধানী ওদের দালান-কোঠায় ভরে গেল। বাংগালীরা পশ্চিমাদের সওদাগরি অফিসের কেরানি ও তাদের দালানের ভাড়াটেরূপে দিন-গুযরান করতে লাগল। 

বাংগালী জাতির দুর্দশা দেখে আসমানে আল্লার দিলে রহম পয়দা হল। তিনি ফেরেশতাদের সংগে সলা-পরামর্শ করলেন। বাংগালী জাতকে তেজারতিতে অনুপ্রাণিত করার নির্দেশ দিয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র নামে একজন দূরদর্শী মনীষীকে বাংলায় পাঠালেন। আচার্য প্রফুল্ল এলেন রাসায়নিকরূপে। তিনি রসায়নাগারের ল্যাবরেটরিতে দীর্ঘদিন গবেষণা করে বুঝতে পারলেন যে, অক্সিজেন হাইড্রোজেন একত্রে মিশালে যেমন পানি  হয়ে য়ায়, তেমনি দেশসেবা ও টাকা একত্রে মিশালেই সুন্দর মুনাফায় রূপান্তরিত হতে পারে। বাংগালী জাতি মূলতঃ দেশপ্রেমিক ও সেবাপরায়ণ জাতি। চিন্তা-জগতে এরা ‘আর্ট-ফর-আর্টস-সেইকের’ সমর্থক হলেও বিষয়-জগতে এরা ‘বিযিনেস্-ফর-বিযিনেসেস্-সেইকের’ সমর্থক নয়। শুধু ব্যবসার জন্য ব্যবসা’ করাকে এরা আত্মার অধঃপতন মনে করে। এরা ‘ধর্মের জন্য ব্যবসা,’ ‘সেবার জন্য ব্যবসা’, ‘দেশ প্রেমের জন্য ব্যবসা,’ ‘কৃষ্টি সভ্যতা ও মানবতার জন্য ব্যবসা’ করে ব্যবসার আধ্যাত্মিক রূপায়ণের পক্ষপাতী। 

খোদা-দত্ত অন্তর্দৃষ্টি-বলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ‘বাংগালীর বৈশিষ্ট্য’ বুঝতে পারলেন। তাই তিনি ব্যবসার হাইড্রোজেনের সংগে আধ্যাত্মিকতার অক্সিজেন মিশিয়ে, বিষয়-জ্ঞানের ক্বাথের উপর দেশ-প্রেমের ভাবনা দিয়ে, এক অপূর্ব মুনাফার পাচন তৈরি করলেন। এই পাচন বিক্রির জন্য তিনি নিজেই প্রচারে বের হলেন। দেশময় তিনি এই মহৌষধির শাখা-দোকান খুললেন। এই দোকানের নাম হল ‘খাদিপ্রতিষ্ঠান’। এই সব শাখা-প্রতিষ্ঠান সংখ্যা-শক্তিতে ‘শক্তি’ ও ‘সাধনা’ ঔষধালয়ের শাখার সংগে পাল্লা দিতে লাগল। 

আচার্যদের দেশময় উদাত্ত সুরে প্রাণস্পর্শী ভাষায় বক্তৃতা করতে লাগলেন। তিনি বলতে লাগলেনঃ ভাটিয়া মাড়োয়ারী দিল্লীওয়ালা সিন্ধী ইস্পাহানীরা তোমাদের দেশের মাল মাত্তা ধন দৌলৎ লুঠে নিল। তোমরা বাংগালীরা কি জাগবে না? তোমরা কি তেজারতির দিকে মন দেবে না?

আচার্যদেবের প্রাণস্পর্শী আহ্বানেই হোক, অথভা খোদাতালা বাংগালী জাতকে সুমতি দিলেন বলেই হোক, বাংগালীর মনে ব্যবসা-স্পৃহা জাগ্রত হল। তারা আচার্যদেবের বক্তৃতা শুনবার জন্য অফিস থেকে ফেরবার পথে সভা-সমিতিতে যোগ দিতে লাগল। 

আচার্যদেবের ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’র লোভনীয় বিবরণে বাংগালীর দেহে রোমাঞ্চ হল। তারা সভায় প্রশ্ন করলঃ ব্যবসা আমরা করতে রাজী হলাম, কিন্তু সব ব্যবসাই যে পশ্চিমারা দখল করে বসে আছে। আমরা কোথায় হাত দেব? 

আচার্যদেবঃ সে ফন্দি আমি বের করিনি মনে করেছ? আমি তিনকুড়ি বছর বৃথাই অক্সিজেন হাইড্রোজেন নাড়াচাড়া করেছি ভেবেছ? ভাটিয়া মাড়োয়ারীদের মত অসভ্য জাত আমরা নই। আমরা শিক্ষিত সভ্য ও কৃষ্টিসম্পন্ন জাত। আমরা ভারতের চিন্তানায়ক। আজ বাংগালী যা ভাবে, অপর সকলে তা ভাবে আগামী কাল। আমরা কি শুধু টাকা-পয়সার লোভে ব্যবসা করতে পারি? আমরা যারা ‘আর্ট-ফর আর্টস সেইক্’-থিওরির জন্য জান দিলাম, আমরা যারা ‘সত্যম শিবম সুন্দরমের’ পূজা করলাম, তারা কি বাট্খারা ও দাঁড়িপাল্লা নিয়ে বসতে পারি শুধু-শুধি? আমাদের মত ইনটেলেক্চুয়াল জাত যদি নেহাত বাটখারা নিয়ে বসিই, তবে আমরা তেল-নুনের কারবার করব না; করব আমরা জন-সেবা ও দেশ-প্রেমের কারবার। বিক্রি যদি আমরা কিছু করিই, তবে চাল-ডাল বিক্রি করব না; করব আমরা ধর্ম ও মানবতা বিক্রি। 

সভায় বিপুল হর্ষধ্বনি ও কানফাটা করতালি পড়ে গেল। করতালি থামলে একজন বললঃ ‘আচার্যদেব, সত্য ধর্ম নীতি ও দেশপ্রেম এ সব দ্রব্য আমরা বিক্রি করতে পারব খুবই; কারণ এ ব্যাপারে আমরা উস্তাদ। কিন্তু কথা এই যে, এগুলো নিয়ে মন্দিরে-মসজিদে ও মঠে-দরগায় তা কারবার চলেই আসছে। তাতে তা বাংগালী জাতের আর্থিক উন্নতি হচ্ছে না। আমরা আর নতুন কি করতে পারব? 

আচার্যদেব মৃদু হেসে বললেনঃ রসায়নশাস্ত্র, বাবা, রসায়ন শাস্ত্র। রসায়নশাস্ত্র না পড়লে এটা বুঝতে পারবে না। আমরা বাংগালী জাত মায়াবাদী, প্রতীক-পূজারী। অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন একত্রে মিশালে যে জল হয়ে যায়, এটা কি মায়া নয়? ব্যবসার মধ্যেও আমাদের এই মায়াবাদের, এই প্রতীক-পূজার, এই অক্সিজেন হাইড্রোজেনের খেলা দেখাতে হবে। তোমরা আমার খাদি প্রতিষ্ঠান দেখছ ত? খাদি ও চরকা একত্রে মিশে কি হয়েছে? এক সুতা খদ্দর তোমরা দেখতে পাও সেখানে? তার বদলে কি দেখতে পাও? চাল ডাল তেল ও ভয়ষা ঘি। দেখলে তা মায়া? খাদি ও চরকা মিশে হয়ে গেল চাল তেল ভয়ষা ঘি। রসায়নশাস্ত্রের এই যে অপূর্ব লীলা, এটা সম্ভব হয়েছে শুধু মায়াবাদের দওলতে। এটাই ব্যবসার মধ্যে ইনটেলেকচুয়াল টাচ। এটাই বৈষয়িকতার উপর আধ্যাত্মিকতার ভাব্না। এটার তাৎপর্য দুমুখো। একদিকে এতে ব্যবসার সংগে আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণে, ইহকালের সংগে পরকালের সমবায়ে, বিষয়নিষ্ঠার সঙ্গে আদর্শনিষ্ঠার যোগাযোগে, তেজারতিকে বাংগালীর ধাত্-সহ করা হল; আরেক দিকে এ ব্যবসাকে অবাংগালীর প্রতিযোগিতার নাগালের নিরাপদ দূরত্বেও রাখা গেল। আমি খদ্দরের সাইনবোর্ড দিয়ে বিক্রি করছি ভয়ষা ঘি। এটা তামালা নয়। তোমরা মনে রেখো, এটাই আধুনিক জীবন-দর্শনের মূলনীতি। রাজনীতি ধর্ম ও সাহিত্যের সর্বত্রই এটা সত্য। যা বলবে তা করবে না, আর, যা করবে তা বলবে না-এরই নাম রাজনীতি বা ডিপ্লোমেসি। মনের ভাব গোপন করবার আর্টের নামই ভাষা বা সাহিত্য, বিশেষতঃ আধুনিক কবিতা। বাইরে নাস্তিকতা প্রচার করে গোপনে কালীতলায় বা মওলাআলীতে মাথা ঠোকা অথবা বাইরে ইসলাম প্রচার করে রাত্রে ফার্পোগ্র্যান্ডে এক পেগ্ টেনে আসাই এ যুগের ধর্ম। ধর্ম রাজনীতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যা সত্য, বাংগালী আমরা ব্যবসাতেও সেই সত্যেরই প্রতিষ্ঠা করব। যার সাইনবোর্ড দেব, তার ব্যবসা করব না। কাস্টমসা’ মাস্ট বি টেকের বাই সারপ্রাইজ-খরিদ্দারকে অতর্কিত আক্রমণ করতে হবে-এটাই আজকার ব্যবসার মূলনীতি। এটা যদি তোমরা করতে পার, তবে কোনো জাতিই তোমাদের সংগে প্রতিযোগিতায় এটে উঠতে পারবে না। বাংগালী জাতি ব্যবসা ক্ষেত্রে সকল জাতির শীর্ষস্থান দখল করবে। 

বিপুল উৎসাহের মধ্যে সভা ভংগ হল।

আচার্যদেব দেখলেন, তাঁর জীবনের মিশন এতদিনে সফল হতে যাচ্ছে; তাই তিন শ্রান্ত দেহে অবসর গ্রহণ করলেন।

বাংগালী জাতির মধ্যে ব্যবসার সাড়া পড়ে গেল। মাতা পিতাকে বধূ বরকে স্ত্রী স্বামীকে পিতা পুত্রকে দাদা-নাতিকে দিনরাত ব্যবসার জন্য তাগিদ করতে লাগল। বাইরের এ শোরগোলকে ব্যবসার হট্টগোল মনে করে প্রাণভরা গর্ব নিয়ে আচর্যদেব তাঁর বিজ্ঞান কলেজের খাটিয়ায় ঘুমিয়ে পড়লেন।


আযিয, নরেন ও ভুড়িওয়ালা তিন বন্ধু।
মিস্টার আবদুল আযিয বিএ. (অনার্স) উঁচুপদের সরকারী কর্মচারী হলেও মুসলিম লীগ-পলিটিক্স্ করে, কারণ লীগ-নেতারাই সম্প্রতি ওযারতি দখল করেছেন। কিছুদিন আগে যখন হক সাহেবের প্রগতিশীল দল ওযারতি করত, তখন আযিয ভয়ানক জাতীয়তাবাদী ছিল; এবং নিজের জাতীয়তাবাদ যাহির করবার জন্য ডাঃ শ্যামা প্রসাদের সংগে তাঁর বাড়িতে দু-একবার দেখাও করেছে। 

শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র নাথ বসু এম.বি. এক হাসপাতালের ডাক্তার। সরকারী চাকুরী করা সত্ত্বেও সে লীগ-মন্ত্রিসভার বিরোধী, কারণ ওটা সাম্প্রদায়িক মন্ত্রিসভা। নরেন ঘোরতর জাতীয়তাবাদী। জেন্য সরকারী কর্তব্যের ফাঁকে অবসর পেলেই সে হিন্দুসভার অফিসে গিয়ে আড্ডা দেয় এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদী লীগ মন্ত্রিসভার কুকীর্তির কথা জাতীয়তাবাদী হিন্দুসভা-নেতাদের কাছে রিপোর্ট করে আসে। 

বাবু রূপারচাঁদ সোনারচাঁদ ভুড়িওয়ালা বড়বাজারের মেসার্স বাট্পাড়িয়া ভুড়িওয়ালা এ-কোম্পানির জুনিয়ার পার্টনার। সে নিজে গো-মাতার ভক্ত ও হিন্দুসভার সমর্থক হলেও মুসলিম লীগের প্রতি তার কোন বিদ্বেষ নেই। সে জন্য সে আযিযকে বলেছে, রায়সাহেবী খেতাব পেলে সে লীগ-তহবিলে যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য করতে রাযী আছে। আযিয ও ভুড়িওয়ালার মধ্যে দুস্তিও এই থেকেই। 

মির্যাপুর পার্কে আচার্যদেবের বক্তৃতা শুনবার পর আযিয ও নরেন দুই বন্ধুতে নরেনের হাসপাতালে ফিরে এসেছে। এখানে রোয সন্ধ্যায় দুই বন্ধুতে আড্ডা বসে। আরও দু’চারজন ইয়ার জুটে। নরেন হাসপাতালের কর্তা বলে তার কোনো কাজকর্ম থাকে না। আড্ডা জমে খুব। 

আচার্যদেবের বক্তৃতার ফলে দু’জনের মাথায়ই ব্যবসা-বুদ্ধি চেপে বসেছে। রাস্তায় সেই তর্ক করতে-করতেই তারা হাসপাতালে ফিরে এসেছে। নরেনের চেম্বারে ঢুকেই সেই তর্কেরই জের চলছে। 

নরেন আযিযের দিকে একটা চেয়ার ঠেলে নিজের নির্দিষ্ট আসনে বসল এবং পকেট থেকে সিগারেটের কেসটা বের করে টেবিলের উপর রেখে পূর্ব কণার রেশ ধরে বললঃ তুমি যাই বল আযিয, আচার্যদেবের প্রত্যেকটি কথা সত্য। 

আযিয চেয়ারে বস্তে-বসতে বললঃ শুধুই কি সত্য? রোমাঞ্চকর বল। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আমাদের নিজেদের হাতে আসবে। কেরানির জাত বাংগালী আমার টাকার স্তূপের উপর বসে পা নাচাব। বড়বাজার ও চিত্তরঞ্জন এভিনিউর পাঁচতলা দালানগুলোর মালিক আমরা হব। কি ফুর্তি, কি আনন্দ। 
নরেন বললঃ ব্যাটা মাড়োয়ারীদের যুলুম থেকে বাংলা মায়ের উদ্ধার হবে-এতেই আমার সবচেয়ে বেশী আনন্দ হচ্ছে।... শালারা আমাদের দেশটা লুটে খাচ্ছে। 

জবাবে আযিয সোৎসাহে আমরা কি সব বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় একটা ভুড়ির ধাক্কায় স্প্রীং-এর হাফডোড়টা ফাঁক হয়ে গেল। 
দেখা দিল ভুড়িওয়ালা। 

দুই হাত কপালে ঠেকিয়ে রাম রাম বলে, সে আযিযকে উদ্দেশ করে বললঃ আপনারকে কুঠি থেকে হামি ঘুরিয়ে এইছি। ছোটা সাহেবলোগ বলছে, আপনে ডগ্ডরবাবুকে এহাঁ হোংগে। সো হামি চলে এইছি। 

ভাগ্যিস নরেনের কথার পিঠে কথা বলে ফেলবার ফুসরত পায়নি, তাই মনে মনে নিজের কপালকে ধন্যবাদ দিয়ে আযিয বললঃ মিঃ ভুড়িওয়ালা যে! আসুন বসুন। এখানে আসবেন, তার আর অত কৈফিয়ত কেন। নরেনের চেম্বার ত আপনারই চেম্বার। কি বল নরেন। 

নরেনের মনটা এতক্ষণ ধরে ‘‘ধরণী দ্বিধা হও, দ্বিধা হও’’ করছিল। এইবার অন্যমনস্ক এস্তব্যস্তভারে সে বল্লঃ নিশ্চয়, নিশ্চয়। বসুন মিঃ ভুড়িওয়ালা। 

নরেন বুঝতে পারল, লজ্জায় তার জিভ আরষ্ট হয়ে গিয়েছে। ভুড়িওয়ালা চেয়ারে বসেই টেবিল পাথালি হাত বাড়িয়ে নরেনের সামনে থেকে সিগারেটের কেসটা টেনে আনল এবং নিতান্ত নিজের জিনিস সাধার মত করেই আযিয ও নরেনকে সিগারেট সেধে নিজে একটা সিগারেট ধরাল। 

নরেনের ঘাম দিয়ে জ¦র ছাড়ল। আযিয নিাশ্চিন্ত হল। যাক, ব্যাটা কিছু শুনতে পায়নি। 

ভুড়িওয়ালা নড়ে-চড়ে চেয়ারে ঠিক জুতসই হয়ে সিগারেটে একটা প্রচন্ড দম দিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে বললঃ আচারিয়া পরফুল দেবনে আজ বহুৎ উমদা তক্বির করেছেন। আপনে লোগ্ গেলে আলবত খুশী হৈতেন। 

নরেনের বুক আবার ধড়ফড় করতে লাগল। সে আযিযের দিকে আড়াচোখে চেয়ে বললঃ কি বল্লেন আচার্যদেব? 

ভুড়িওয়ালা সপ্রতিভভাবে বললঃ কহলেন সব হক কথা। এই বাংগালীলোক খালি নওক্রি নওক্রি করে, বিয্নেসকে তরফ খেয়াল করে না। ঔরভী কহলেন, মাড়বারীলোগ্ বাংগাল মূলুক লুটপাট করতে আছে...

নরেন ভুড়িওয়ালার চোখে-মুখে একটা তীব্র সন্ধানী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলঃ মাড়োয়ারীদের তিনি এত গাল দিলেন, এতে আপনার মনে কষ্ট হল না?

ভুড়িওয়ালা হেসে মাথা নেড়ে বললঃ রাম রাম। গালিয়া কাঁহা দিছেন? সব ত হক কথা কহছেন। আপনা দেশমে বাংগালীলোগ তেজারত র্কবে না ত কি বিদেশী লোগ তেজারত করবে? হাম মাড়বারী লোগকো আপনে ভদ্দর লোগ্নে নাহক গলৎ সমঝিয়েছেন। 

বলে ভুড়িওয়ালা বাংগালী জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সম্বন্ধে এমন সব উদারতাপূর্ণ বাস্তববাদী কথা বল্তে লাগল, যার ফলে আযিয ও নরেন অল্পক্ষণের মধ্যেই এ বিষয়ে নিজেদের মনের কথা ব্যক্ত করে ফেলল। এমন কি, এ কথাও তারা বলে ফেলল যে তারাও আচার্যদেবের সভায় গিয়েছিল এবং এইমাত্র সেখান থেকেই আস্ছে। 

দিল্ খোলাখুলি যখন শুরু হল, তখন ভুড়িওয়ালাও বলে ফেলল যে, সেটা ভুড়িওয়ালা জানে এবং খদ্দরের গান্ধীটুপি পকেটে লুকিয়ে ভুড়িওয়ালা আযিয-নরেনের পিছু-পিছুই হাসপাতাল পর্যন্ত এসেছে। এমনকি, নড়েনের চেম্বারে ঢুকে আযিয-নরেনে যে আলাপ হয়েছে তাও সে শুনেছে। 

পরন্তু-ভুড়িওয়ালা নিরুদ্বেগে বলে যেতে লাগলঃ 
নরেনবাবুকে বাৎমে দোষের কথা কুচ নেহি আছে। মরমকি ভাৎভী ক্যা আছে? হামার মুলুককি তেজারত দুসরা লোক কব্যা করলে হামরা দেশওয়ালীলোগ ভী ত এয়সাই কথা বল্ত। হামলোগ্ চাহতে আছে কে বাংগালী লোক তেজারতমে তরক্কী করে।

উদারতার অবাধ আদান-প্রদান হল। শেষ পর্যন্ত ভুড়িওয়ালা বলল যে, আগার আযিয ও নরেন তেজারত করতে চায়, তবে ভুড়িওয়ালা ক্যাপিটাল দিয়ে তাদের এমদাদ করতে ভী রাজী আছে।

সেটা নিতে আযিয নরেন সহজেই রাজী হল। তাছাড়া ভুড়ি-ওয়ালার উপদেশ-পরামর্শও চাইল, কারণ তারা এ ব্যাপারে নতুন। 

সেটাও দিতে ভুড়িওয়ালা সানন্দে রাজী হল। সে বললঃ এই ধরুন, নরেনবাবুকে হাসপাতাল। এই হাপাতালমে রোজ চাউল ডাল আটা দুধ ফল রোটী চা চিনি ওগায়রাহ যে সব জিনিস সাপ্লাই হয়, তাতে হাজার রূপায়া দাম লাগে। এই হাজার রূপায়ামে কমসেকস্ ত তিন চার সো রূপায়া মুনাফা থাকে। বেগানা লোগ্কো কন্ট্রাক্ট না দিয়ে যদি নরেনবাবু বেনামী কয়েক খোদ এ কণ্ট্রাক্ট লে লেয়, তব মাহিনামে নরেনবাবুকো দশবারো হাজার রূপায়া মুনাফা হোবে। আওর লিজিয়ে, আপ আযিয সাবকি বাত। উন্কা সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টমে লড়াইকে যরিয়ে সে লাখো রূপায়াকা কারবার হৈতে আছে। আযিয সাব আগার কোই আপনা আরদমিকে নামপর উস্মেসে দুচারঠো কণ্ট্রাক্ট লে লেয়, তব রূপায়া রাখবার জায়গা কাহা? কণ্ট্রাক্ট আললোগ লিয়ে লেন, ক্যাপিটালকা ফেকের মৎ করবেন। 

নরেন ও আযিয কিন্তু এতে উৎসাহিত হল না। তারা যা বলল তার সার অর্থ এইঃ যতই লাভ দেখা যায়, কণ্ট্রাক্টারিতে লোকসানের রিস্ক আছে। আযিয ও নরেন এমন ব্যবসা করতে চায়, যাতে শুধুই লাভ আছে, অথচ লোকসানের কোন রিস্ক নেই। 

ভুড়িওয়ালা অনেক তর্ক করে বুঝাবার চেষ্টা করল যে, এই ধরনের কণ্ট্রাক্ট লোকসানের রিস্কটা একটা কথার কথা মাত্র। আসলে লোকসান কোন কালেই হয় না। 

কিন্তু আযিয ও নরেনের কাছে তর্কে হেরে গিয়ে সে স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, এতে অন্ততঃ থিওরেটিক্যালি লোকসানের রিস্ক রয়েছে। সেটুকু রিস্ক নিয়েও আযিয ও নরেন কারবার করতে রাযী নয়। ভুড়িওয়ালা চোখ কপালে তুরে বললঃ অ্যঅয়সা তেজারতি কাহাঁ বিলেগা বাবুজি, জিসমে নোক্সানকা যরা ভী সম্ভাবনা না হোবে?

নরেন ও আযিয হো হো করে হেসে উঠল। নরেন বললঃ সেটা বাংগালীর বুদ্ধির একচেটে ব্যাপার; মাড়োয়ারী বা কোন অবাংগালী মাথায় সেটা ঢুকবে না। 
আযিয বললঃ তাছাড়া, আমরা বাংগালীরা যে ব্যবসা করব, তাতে ক্যাপিটালের দরকার হবে না। আপনি কিছু মনে করবেন-না মিঃ ভুড়িওয়ালা, আপনার কাছ থেকে ক্যাপিটাল পেলেও তা আমরা নিতে চাই না। কারণ তাতেও রিস্ক আছে। কে জানে, এই দেনার দায়েই আপনারা একদিন আমাদের কারবার নিয়ে যাবেন না? ভুড়িওয়ালার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে হেসে বললঃ আব সমঝলাম, আপলোগ হামার সাথে মশকরা করতে আছেন। 

নরেন বললঃ মশকরা নয় মিঃ ভুড়িওয়ালা। আপনার কাছে বলতে দোষ নেই, কারণ আপনি আমাদের বন্ধু ব্যক্তি; আপনি বুঝবেনও না এসব, কারণ এসব সায়েন্টিফিক্ কথা। হাসপাতালের সাপ্লাই দিয়ে রোজ তিন-চারশো টাকা লাভ করতে যে উপদেশ আপনি আমায় দিলেন সেটা আমি কণ্ট্রাক্টারি না করেও করতে পারি। আমি যদি রোগীর পথ্য কমিয়ে দি, দুধ রুটি মাখন দেওয়া বন্ধ করে দি, নিতান্ত জরুরী কেসে জল মিশিয়ে দুধ দি, আর সাপ্লাই করা সব জিনিস যদি পিছনের দরজা দিয়ে বিক্রি করে দি তবে হিসেব করুন ত কত টাকা থাকবে। তা থেকে শতকরা পঁচিশ টাকা বাদ দিন, কারণ অধীনস্থ লোকগুলো মুখ বন্ধ করবার জন্য ওদেরকে ওটা দিতে হবে। 

ভুড়িওয়ালার চোখ দুটো উপরের দিকে ঠেলে উঠতে উঠতে ভুরু দুটোকে কপালের চুলের সঙ্গে এককার করে দিল। সে ঢোক গিলতে-গিলতে বললঃ রোগীলোগ কা পথ্য মেরে মুনাফা কোরবেন ডগডর বাবু? এয়সা অধর্ম করতে পারবেন?

নরেন একটু কঠোর ভাষায় জবাব দিলঃ আরে রেখে দিন ধর্মের কথা। আপনাদের ধর্মজ্ঞান আমাদের খুব জানা আছে। ভুতের মুখে রাম না আর কি! 
দুঃখিত হয়ে ভুড়িওয়ালা বললঃ হোতে পারে কাবুজী হামলোগ ধার্মিক না আছে; হোতে পারে হামলোগ টাকাকে খাতের গউ-মাতাকা চামড়ার কারবার ভী করতে আছে। লেকেন হাসপাতালকা রোগীয়োঁ কা পথ্য চোরি করকে রূপেয়া কামনা? না বাবুজী, আজতক হামলোগ সে এ কাম হৈছে না। 

নিরাশ গলায় আযিযের দিকে চেয়ে সে বললঃ আর আপ্নে ক্যা তেজারত কোরবেন, আযিয সাহাব? 

আযিয সগর্বে বললঃ কণ্ট্রাক্টারি করা আমাদের পদ-মর্যাদার হানিকর। আমি নিজে ত তা করবই না, আমার আত্মীয়-স্বজনও তা করবে না। কেন করব? কণ্ট্রাক্ট বিলি করেই ত ঢের রোযগার করতে পারব। এর কণ্ট্রাক্ট কেটে ওকে আর ওরটা কেটে একে দিব। কণ্ট্রাক্টরদের দেওয়া সাপ্লাই পাঁচটা পেয়ে দশটার রশিদ লিখে দিব! রূপা পেয়ে সোনার রশিদ দিব। ধরবে কে আমাদের? স্টোরকিপারদের ভাগ দিতে হবে এই ত? তা দিব। আসল কথা কি জানেন মিঃ ভুড়িওয়ালা, বিনা-টাকায় কারো সংগে কথাটি কইব না। বিনা-সালামিতে চাপরাশী-দারোয়ানের চাকরিটা পর্যন্ত দিব না। চাকরি দিয়ে ওদের মাইনের উপর টাকা প্রতি দু’পয়সা ট্যাক্স বসাব। বিনা দর্শনীতে কাউকে ইন্টারভিউ দিব না। বিনা-নযরে চাকুরী প্রার্থীর দরখাস্তই গ্রহণ করব না। কি বলছেন আপনি মিঃ ভুড়িওয়ালা, আমরা বাংগালীরা, ইচ্ছে করলে এতদিন ব্যবসা করতে পারতাম না? আমরা যারা মসজিদে যাই, নামায পড়তে নয়-জুতো চুড়ি করতে; আমরা যারা মন্দিরে যাই, ঠাকুর পূজ্তে নয়-পকেট মারতে-তারা ইচ্ছে করলে ব্যবসাতে মাড়োয়ারীদেরে হারাতে পারি না? ইচ্ছে করিনি এতদিন তাইত!
বিস্ময় ও ভক্তিতে গদগদ হয়ে ভুড়িওয়ালা করযোড়ে উভয়কে নমস্কার করে বিদেয় হল। যেতে-যেতে বললঃ ধন্য বাংগালীকা মগজ! হোয়াট বেঙ্গল থিংকস্ টু-ডে, ই-য়া থিংকস্, টু-মরো। রাম-রাম বাবুজী, রাম-রাম।


আযিয-নরেনের উদ্যোগে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নিখিল-বংগ-বণিক-সংঘ গঠিত হল। সংঘের প্রথম বৈঠকে বাংগালী জাতির ব্যবসার মূলনীতি রচিত হল। তা এইঃ 

(১)    নিছক ব্যবসার জন্যই ব্যবসা করা হবে না। ধর্ম সেবা জন-সেবা ও দেশ-সেবার নামে ব্যবসা চালান হবে। 

(২)    বিনা-মূলধনে ও বিনা-রিস্কে ব্যবসা করা হবে। যেসব বাংগালী সরকারী পদে অধিষ্টিত আছেন, অথবা যাঁরা কংগ্রেস মুসলিম লীগ হিন্দুসভা কৃষক প্রজাপার্টি ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রয়েছেন, তাদের পক্ষে ঐসব পদে বহাল থেকেই বিনা মূলধনে ও বিনা-রিস্কে ব্যবসা চালান অধিকতর সুবিধাজনক বিবেচিত হওয়ায় তাদের পদত্যাগ করতে হবে না, বরঞ্চ আরো অধিক সংখ্যায় ব্যবসায়ীকে ঐ সব পদে ঢুকানো হবে। 

(৩)    আচার্যদেব-প্রতিষ্ঠিত খাদি প্রতিষ্ঠানের পবিত্র আদর্শ সামনে রেখে কারবারে মিসলিডিং সাইনবোর্ড দেওয়া হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বংগীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সাইনবোর্ড দিয়ে যুুদ্ধ-প্রচেষ্টার প্রিণ্টিং বিযনেস করা হবে; মুসলিম লীগের সাইনবোর্ড দিয়ে সামরিক বিভাগের এ্যারোড্রোমের কণ্ট্রাক্ট নেওয়া হবে; হিন্দুসভার সাইনবোর্ড দিয়ে সৈন্য রিক্রুটিং বিযনেস করা হবে; কৃষখ-প্রজার সাইনবোর্ড দিয়ে ব্যাংকিং বিযনেস করা হবে; গৌ-রকষা-কমিটির সাইনবোর্ড দিয়ে চামড়ার বিযনেস করা হবে; হাসপাতালের সাইনবোর্ড দিয়ে রোগীর পথ্য ও ওষুধ মেরে দিয়ে চাল-ডাল মাখন-রুটি ও ওষুধপত্রের বিযনেস করা হবে; ফ্রী কিচেন ক্যানটিন ও লংগরখানার সাইনবোর্ড দিয়ে দানের চাল-ডাল উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হবে; সৎকার সমিতি ও জানাযা কমিটির সাইনবোর্ড দিয়ে শ্মশানের কাঠ ও কাফনের কাপড় বিক্রি করা হবে। শুধু দৃষ্টান্তস্বরূপ এই কয়টি বিযনেসের নামাল্লেখ করা গেল। বাকীগুলোর কথা সংঘের মেম্বরগণ ইশারায় বুঝে নেবেন। বুদ্ধির স্থুলতাহেতু যেসব মেম্বর ইশারায় বুঝবেন না তাঁরা দশ টাকা দর্শনী দিয়ে সংঘের সেক্রেটারির সংগে সাক্ষাৎ করবেন; মৌখিক উপদেশ দেওয়া হবে। 

এর ফল যা হল, তা কেউ ভাবতে পারেনি। কেরানির জাত বাংগালী রাতারাতি ব্যবসায়ীর জাতে পরিণত হল। অফিসে-আদালতে স্কুলে-কলেজে মন্দিরে-মসজিদে মঠে-দরগায় হাসপাতালে-এতিমখানায় বাড়িতে-বাজারে হাটে-মাঠে রাস্তায়-ঘাটে ঘরে-বাইরে ব্যবসার বিপুল বন্যা প্রবাহিত হল। বিনা-লাভে কেউ কোনো কাজ করে না। টাকা ছাড়া কেউ কোনো কথা বলে না। ওযির নাযির পাত্র-মিত্র কেউ বিনা-ভেটে মোলাকাত দেন না। বিনা-নযরে মেম্বররা ভোটারদের সংগেও দেখা করেন না। বিনা-দর্শনীতে ডাক্তার হাসপাতালে রোগী ভর্তি করেন না। বিনা-দক্ষিণায় হেডমাস্টার স্কুলে ছাত্র ভর্তি করেন না; বিনা তদবিরে গাড়ির টিকিট পাওয়া যায় না। এমনকি ডাক-টিকিটও না। ‘পান খাওয়ার’ ব্যবস্থা না করলে চাকরিত দুরের কথা নমিনেশনও পাওয়া যায় না। গতিক ক্রমে এমন দাঁড়ালে যে অগ্রিম গহনা-মাড়ির ওয়াদা না করলে স্ত্রী স্বামীকে বিছানায় উঠতে দেয় না। লাটিম, ঘুট্টি ও ট্রাইসাইকেলের প্রতিশ্রুতি না দিলে ছয় বছরের শিশু পর্যন্ত পড়াশোনা করতে চান না। বকশিশের দাবি অগ্রিম স্বীকার না করলে রিকশা বা ঘোড়ার গাড়ি পর্যন্ত পাওয়া যায় না। 

বাংগালী জাতির নয়া উদ্যমের এই সায়েন্টিফিক্ বিযিনেসের চোটে তাদের আর্থিক অবস্থা ভয়ানক ভাল হয়ে গেল; তাতে দেশে খোরাক-পোশাকের দাম চড়ে গেল। সরকার মূল্য-নিয়ন্ত্রণের আইন করলেন। বাজার থেকে চাল কাপড় পালিয়ে গেল। সরকার চুরি রুখবার জন্য পাহারাদার বসালেন। কিন্তু বেড়াই ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলল। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ হল। বাংগালীর ব্যবসা-ক্ষেত্র আরো প্রসারিত হল। রিলিফ কমিটি, সেবাসমিতি, হাসপাতাল, ফ্রিকিচেন, সৎকার-সমিতি ও জানাযা-আঞ্জুমান লাখে-লাখে প্রতিষ্ঠিত হল। মৃত্যু-সংখ্যাও কাজেই লাফিয়ে বেড়ে যেতে লাগল। 

সরকার ভাবনায় পড়লেন। বিদেশে থেকে গাড়ি-গাড়ি চাল-ডাল ও থলে থলে টাকা পয়সা আনতে লাগলেন। কিন্তু ওসব বাংলার সরহদ্দে এসেই কর্পূরের মত উবে যেতে লাগল। কারণ নিখিল বংগ বণিক-সংঘের মেম্বররা সংঘের তরিকা অনুসারে ঐসব মালের ছাড়-পত্র যোগাড় করে যেতে লাগলেন। 

কিছুতেই কিছু হল না। বাংগালী জাতির ব্যবসায়িক উন্নতির পথে বাধা দেওয়ার সমস্ত সরকারী প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হল। বহু বাংগালী দরিদ্র কেরানি, ব্রিফলেস উকিল ও হাতুড়ে ডাক্তারের ব্যাংক ব্যালেন্স ফেঁপে উঠল। এইভাবে বাংলার ন্যাশনাল ক্যাপিটেল গড়ে উঠল। 

কিন্তু বাংগালী অভুক্ত থেকে গেল। অনাহারে লাখ-লাখ বাংগালী রাস্তায় পড়ে মরতে লাগল। রাস্তায় পড়ে মরতে যাদের এক সপ্তাহ সময় লাগছিল, নরেনের হাসপাতালে ঢুকে তারাই একদিনের মধ্যে মৃত্যু যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে লাগ্ল। কারণ নরেনের হাসপাতালে সরকারের দেওয়া ইন্জেকশন, ঔষধ, গ্লুকোয, দুধ-বার্লি ও আনারস-বেদানার গাড়ি হাসপাতালের সামনের গেট দিয়ে ঢুকে পিছনের গেট দিয়ে বের হয়ে দোকানে চলে যেতে লাগল। নরেন তার বদলে রোগীর ঔষধের নামে গংগার পানি দিতে এবং পথ্যের নামে বাজরার জাউ, ভাতের ফ্যান ও বাতাবিলেবুর খোসা খাওয়াতে লাগল। ফলে দৈনিক হাজার-হাজার বাংগালী নরেনের হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে স্বর্গে যাওয়ার পথে আযিযের পরিচালিত সৎকার সমিতি ও জানাযা-আঞ্জুমানের লরিতে চড়তে লাগল। আযিযের সুশিক্ষিত শিষ্য-শাগরিদরাও লরি-লরি মৃতদেহ ময়লা ঢালার মত গংগায় ঢেলে এসে মাথা-পিছু পাঁচ টাকা পোড়াই খরচা ও সাড়ে পাঁচ টাকা দাফন খরচা বিল করতে লাগ্ল। 

আযিয-নরেনের আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব ছাড়া আর সব বাংগালী অনাহারে মরে গেল। 

লক্ষকোটি লোকের মৃতদেহ পচে প্রথমে গংগার পানি ও শেষে বংগোপসাগরের পানি নষ্ট হয়ে গেল। তাতে পল্ তার কলের পানিও স্বভাবতঃই বিষাক্ত হয়ে গেল। সে পানি খেয়ে গোষ্ঠী-শুদ্ধ নরেন-আযিযও অবশেষে মারা গেল। 

বাংগালীর মত একটা ঐতিহাসিক জাত এইভাবে নিপাত হল।

হারাধনের ছয়পুত্র মারা যাওয়ায় সপ্তম পুত্র ভেউ-ভেউ করে কেঁদে বনে গিয়েছিল। সে হয়তো আজো বেঁচে আছে, কিংবা বেঁচে নেই। বেঁচে সে থাক আর নাই থাক, হারাধনের ছয় ছেলের জন্য কাঁদবার অন্ততঃ একটি লোক ছিল। 

কিন্তু বাংগালী জাতি রজন্য কাঁদবারও কেউ থাক্ল না। 


পরকাল।
মহাবিচারের দিন। হাশরের ময়দান। 
মহাবিচারক আল্লার আরশ থেকে হুকুম হলঃ বাংগালী জাতির সব লোক দুযুখে যাবে; কারণ এরা তেজারতি করে গোটা জাতটাই ধ্বংস করেছিল এবং তাতে আমার সৃষ্টির এক অংশ দুনিয়া থেকে লোপ পেয়েছিল। 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে বললেনঃ ন্যায়ের অবতার যে মহাপ্রভূ, একের তুমি দশজনকে সাজা দিয়ে ন্যায়ের মর্যাদা নষ্ট করতে পার না। কয়েকজন লোক ব্যবসা করে গোটা বাংগালী জাতকে মেরে ফেলেছিল। ঐ কয়জনকে তুমি যে-কোনো সাজা দিতে পার; কিন্তু যারা অনাহারে জান দিল, ঐ মযলুমদের তুমি সাজা দিচ্ছ কোন্ যুক্তিতে? আরশ থেকে হুকুম হলঃ যুক্তি তোমারই হে কবি, তুমি নিজের কবিতার কথা স্মরণ করঃ 
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা দোঁহে যেন সমভাবে দহে
কবির লজ্জায় বসে পড়লেন। 

এইবার দাঁড়ালেন বিখ্যাত আইনজীবী ডাঃ রাসবিহারী ঘোষ। তিনি বললেনঃ বাংগালী জাতির কোনো অপরাধ নেই, মি লর্ড। তারা খুশী-খোশালেতে কেরানিগিরি ও চাপরাশীগিরি করেই খাচ্ছিল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রই যত গোলমাল বাধান। তিনিই ত গিয়ে তাদের তেজারতিতে কুমতি দেন। শাস্তি যদি কারো পেতে হয়, তবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রই পাওয়া উচিত। 

আরশ থেকে নেদা এলঃ ডাঃ ঘোষ ঠিক কথাই বলেছেন। বেঁধে আন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে। 

ফেরেশ্তারা ছুটলেন আচার্য দেবকে ধরে আনতে। 

আচার্যদেব নিশ্চিন্ত মনে বেহেশ্তের একবাটি শরাবনতহুরা নিয়ে দুযখের আগুনে তাই জ্বাল করে অক্সিজেন-হাইড্রোজেনের খেলা দেখছিলেন; এমন সময় ফেরেশ্তারা তাঁকে ধরে হাতে-পায়ে টেনে-হেচ্ড়িয়ে হাশরের ময়দানে নিয়ে এলেন। 

র্আশ থেকে হুকুম হলঃ আচার্যদেবকে দুযখে নিয়ে যাও। 

দুনিয়ায় যিনি সকলের সংকটত্রাণ করে বেড়িয়েছেন তিনিই আজ নিজে এমন সংকটে পড়লেন দেখে হাশরে জমায়েত জনতা হায়-হায় করে উঠল। কিন্তু কেই কোন প্রতিবাদ করছে না দেখে বিখ্যাত ফোজদারি উকিল হক সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বললেনঃ আচার্যদেব আমার গুরু মশায়। তাঁর হয়ে আমি একটা কথা না বলে পারছি না ইওর অনার। তিনি যে বাংগালী জাতকে তেজারতি শেখাতে গিয়েছিলেন তা হুযুরপাক বারিতালারই হুকুমে। হুযুরের বিনা হুকুমে গাছের পাতাও নড়ে না। কাজেই র্আশ থেকে এবার নেদা হলঃ হকসাহেব হক কথাই বলেছেন। আমি ইনসাফের মালিক। বেইনসাব আমি করতে পারি না। বাংগালী জাতকে দুযখের আগুন থেকে রেহাই দেওয়া হল। বেহেশ্তেই তাদের জায়গা দেওয়া হবে। কিন্তু বেহেশ্তে তাদের কোনো শরাফৎ দেওয়া হবে না। তারা শুধু বেহেশ্ তের কেরানিগিরি ও চাপরাশীগিরি করবে। এই আমার রায়। 

তাই হল। 

বাংগালী জাত বেহেশ্তের কেরানি ও চাপরাশী বহাল হল। 

******

খোদার দরবারে আবার এণ্টি-কোরাপশান ট্রাইবুনাল বস্ল। অভিযোগঃ বেহেশ্তের মেওয়া ও শরবৎ পাওয়া যাচ্ছে না। সাপ্লাই বিভাগে চুরি হচ্ছে। বহু বেহেশ্তী দুযখে ও বহু দুযখী বেহেশ্তে ঢুকে পড়েছে। 

ফেরেশ্তারা এক জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি কমিশন বসিয়েছিলেন। তার রিপোর্টও ট্রাইবুনালের সামনে পেশ করা হয়েছে। সে রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বাংগালী কেরানি ও চাপরাশীদের যোগাযোগে বেহেশ্তে বহু পারমিট দুযখীদের কাছে বিক্রি হয়েছে; বহু গেটপাস দুযখীদের হস্তগত হয়েছে। তাতেই বহু দুযখী বেহেশ্তে ঢুকে পড়েছে। বেহেশ্তের বহু মেওয়া ও শরবত পিছনের দরজা দিয়ে ব্ল্যাক মার্কেট দরে দুযখে চলে যাচ্ছে। 

সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে ট্রাইবুনাল রায় দিলেন। আল্লাহতালা অরশ থেকে হুকুম করলেনঃ সমস্ত বাংগালীকে বেহেশ্তের চাকুরী থেকে ডিসমিস করে হাবিয়া দুযখে ফেলে দাও। তারপর হাবিয়া দুযখের উপর মাটিচাপা দিয়ে দুনিয়া-আসমান থেকে বাংগালী জাতির নাম মুছে ফেল। 

সমস্ত বাঙালী হায় হায় করে উঠল। শেষবারে মত চেষ্টা করতে গিয়ে মিঃ নলিনীরঞ্জন সরকার বললেনঃ হে সদাপ্রভু, সমস্ত দোষ আমাদের। তোমার দয়ার দাবি আমরা আর করতে পারি না। বেহেশ্তের আশাও আমরা করি না। কিন্তু কেরানি চাপরাশীর জাত আমরা কেরানি-চাপরাশীগিরি ছাড়া বাঁচব না। আমাদের তুমি দয়া করে দুযখের কেরানি-চাপরাশী করে দাও। সেখানে ত বিযিনেস্ করবার মত কোন জিনিস নেই। আরশ থেকে নেদা হলঃ তেজারতি তোমরা যা শিখেছ, তাতে দুযখের চাকরি দিয়েও তোমাদের আর বিশ্বাস নেই। ফেরশ্তাগণ, আমার হুকুম তামিল কর- এদের হাবিয়া দুযখে মাটিচাপা দাও। 

এবং- 
ইন্সাফের মালিক একটু থেমে কঠোর ভাষায় আবার বললেনঃ হাঁ, আরেকটা কথা। বাংগালী জাত যেখানে-যেখানে বাস করেছে, হাইজিনিক-মেযার হিসেবে সে সব জায়গায় বেশ করে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দাও। 

 

আবুল মনসুর আহমদ-এর ‘ফুড কনফারেন্স’ বই থেকে সংগৃহিত।

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ