আজকের শিরোনাম :

কবি নজরুলের বাংলা ভাষার মাধ্যমে ধর্মকে পরিচিত করার প্রচেষ্টা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০১৮, ১৭:০৯

মোহীত উল আলম, ৩০ মে, এবিনিউজ : ‘মোরা একই বৃন্তে দুইটি ফুল/ হিন্দু মুসলমান।’
কবি নজরুল একাধারে অসাম্প্রদায়িক আর সমন্বয়বাদী কবি ছিলেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ওপরে উদ্ধৃত ফুলটির মতোই নিটোল ছিল, যার নিগড়ে ছিল দুইটি সত্তাণ্ডইসলামিক আর বৈদিক। আমার এ নিবন্ধে নজরুল বাংলা ভাষার মাধ্যমে বাঙালির মনে ধর্মের মৌলিক তাড়নার সঙ্গে পরিচিতি বাড়ানোর প্রচেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা করব। আমি এটা বলছি না যে নজরুল ধর্ম–প্রচারকের ভূমিকায় নেমেছিলেন, কিন্তু ইসলামী গান, আমপারার তর্জমা এবং অন্যদিকে হিন্দু ধর্মের আজ্ঞানুযায়ী ভক্তিমূলক গান রচনা করার পেছনে তাঁর ধর্মের প্রতি মানুষের মন যেন সঠিক কারণে ধাবিত হয় সেদিকে লক্ষ্য ছিল। মানুষতো কোন কাজ উদ্দেশ্যবিহীন করে না। তবে এ আলোচনায় আমি নজরুলের ভক্তিমূলক গান রচনার বিষয়টি আনব না, কেননা ওগুলো রচনার সঙ্গে বৈদিক ধর্মের ভাষার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। অর্থাৎ, হিন্দুদের ধর্মানুযায়ী ভক্তিমূলক গান রচনা করতে নজরুলকে অনুবাদকের ভূমিকায় নামতে হয়নি। তবে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বুঝতে এ তথ্যটাই সহায়ক—যেটি অধ্যাপক র‌্যাচেল ফেল ম্যাকডারমট তাঁর সিংগিং টু দ্য গডেস: পোয়েমস টু কালী এ্যান্ড উমা ফ্রম বেংগল (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০১) গ্রন্থে বলেছেন—যে এই ঘরানার কবিদের মধ্যে নজরুল ইসলামই একমাত্র মুসলমান কবি ছিলেন। কিন্তু আমি নজরুলের ইসলামী গান ও আমপারার তর্জমার প্রসঙ্গ এ জন্য আনছি কারণ নজরুল সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলা ভাষায় ধর্ম পাঠ ও ব্যবহার না করলে বাঙালি মুসলমানেরা অন্ধকারে থেকে যাবে। ঠিক যেমন ষষ্ঠদশ শতকের শুরুর দিকে ইংরেজ মনিষী উইলিয়াম টিনডেল বাইবেল হিব্রু এবং গ্রিক টেক্সট থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে প্রবৃত্ত হোন। তিনি বলেছিলেন, ধর্ম পবিত্রগ্রন্থ অনুযায়ী পালন করতে গেলে যার যার মাতৃভাষায় করতে হবে।

নজরুল তাঁর কাব্য আমপারা অনুবাদের মুখবন্ধে বলছেন সেরকমেরই একটি কথা:

‘ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র–পুঁজি ধনরত্ন মণি–মাণিক্য সবকিছু কোরআন মজিদের মণি–মঞ্জুষায় ভরা, তাও আবার আরবি ভাষার চাবি দেওয়া। আমরা বাঙালি মুসলমানেরা তা নিয়ে অন্ধ–ভক্তি ভরে কেবল নাড়াচাড়া করি। . . . আজ যদি আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিগণ এই কোরআন মজীদ, হাদিস, ফেকা প্রভৃতির বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন তা হলে বাঙালি মুসলমানের তথা বিশ্ব–মুসলিম সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করবেন। অজ্ঞান–অন্ধকারের বিবরে পতিত বাঙালি মুসলমানদের তাঁরা বিশ্বের আলোক–অভিযানের সহযাত্রী করার সহায়তা করবেন। (মনোয়ার হোসেন, নজরুলের কাব্য আমপারা, নজরুল ইনস্টিটিউট, ২০০১, পৃ. ১১।)

‘চাবি’ শব্দটা একটা পাসওয়ার্ডের মতো। সে পাসওয়ার্ড না জানলেতো আমাদের ধর্মীয়বোধের মনের আগল খুলবে না। নজরুলের ‘অজ্ঞান–অন্ধকারের বিবরে পতিত বাঙালি মুসলমানদের’ বাক্যাংশটি প্রণিধানে আনলে আমরা বুঝতে পারব কেন তিনি আমপারার সূরাগুলো অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন।

মনোয়ারের বইটির সূচিপত্রে দেখান হচ্ছে ‘সুরা ফাতেহা’ থেকে শুরু করে–ধারাবাহিকভাবে নয়-‘সুরা নাবা’ পর্যন্ত নজরুল মোট আটত্রিশটি সুরা অনুবাদ করেছিলেন। মনোয়ার হোসেন তাঁর সমাপনী বক্তব্যে লিখেছেন নজরুল পবিত্র কোরানের অর্থ আক্ষরিকভাবে ঠিক রাখার জন্য মাঝে মাঝে ছন্দের ব্যত্যয় এবং কাব্য সৌন্দর্যের মানহানিও মেনে নিয়েছিলেন।

বিশিষ্ট নজরুল–সংগীত গায়িকা মোস্তারী পারভীন টিনা তাঁর নজরুলের ইসলামী গান ও ভক্তিগীতি গ্রন্থে (২০১৩) জানাচ্ছেন নজরুল হযরত মুহম্মদ (স.)-এর ওপর তাঁর সর্বাধিক ইসলামিক গান লিখেছিলেন। তাঁর আবির্ভাব, তিরোভাব, এবং মহিমা কীর্তন করে তিনি গান রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া আল্লাহ্‌র প্রশস্তিমূলক গান ‘হামদ’ ও ঈদ, রমজান, আযান, মসজিদ ও নামাজ এবং মোহররমের ওপর তিনি গান লিখেছিলেন। গান লিখেছিলেন বিবি ফাতেমার ওপর, আরব, মক্কা, মদিনার ওপর। গজলের প্রসার নজরুলের হাতেই ঘটেছিল।

২.

কবি ডব্লিউ এইচ অডেন কবিতায় কবির জীবনকে খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ১৯৩৬ সালে রচিত ‘হু ইজ হু’ শীর্ষক একটি কবিতায় এ প্রচেষ্টাকে ঠাট্টা করে লিখছেন যে এক শিলিং দিয়ে কেনা যে কোন জীবনচরিত কবির জীবন সম্পর্কে তোমাকে সব তথ্য দেবে: কবে তাকে পিতা পিটিয়েছিল, কবে সে স্কুল পালিয়েছিল ইত্যাদি। কবিতাটি একটি চতুর্দশপদী। ষষ্ঠীপদে গিয়ে বলছেন, হয়ত কবি সম্পর্কে তোমাকে এমন তথ্যও দেয়া হবে যে কোন গৃহরমণীর জন্য কবির প্রাণ উদ্বেলিত ছিল, যে গৃহরমণী আবার ছিলেন ভয়ঙ্কর গৃহকাজে ব্যস্ত, আর কবির প্রতি ছিলেন সাংঘাতিক উদাসীন, যিনি কবির প্রেম–ভরভর লম্বা লম্বা চিঠির কোনটির হয়ত উত্তর দিতেন, বেশিরভাগেরই দিতেন না, কিন্তু কোন চিঠিই সংগ্রহে রাখতেন না।

অডেন ছিলেন টি এস এলিয়টেরা ইংরেজি কবিতার যে আধুনিক ঘরানা তৈরি করেছিলেন সে ঘরানার শেষ পর্যায়ের কবি। এর পর উত্তরাধুনিক যুগের শুরু হয়, এবং সাহিত্যালোচনা কবিতার কেন্দ্রগুলোকে ছেড়ে প্রান্তবর্তী প্রদেশসমূহে মনোনিবেশ করে, যার প্রধানতম আলো পড়ে কবি বা লেখকের জীবনের ওপর। জীবন ও যুগভিত্তিক সাহিত্যপাঠের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক এক অর্থে যেমন এডওয়ার্ড সাঈদ, আরেক অর্থে নব্য ইতিহাসবাদের জনক অধ্যাপক স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট। ২০১৭ সালে গ্রিনব্ল্যাট একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যেটির শিরোনাম দ্য রাইজ এ্যান্ড ফল অব এ্যাডাম এ্যান্ড ঈভ। বইটি মূলত কী করে জেনেসিস এবং বাইবেল কথিত আদম এবং হাওয়া ধর্মীয়–পুরাণ থেকে বাস্তবে রূপ পেতে পেতে ক্রমশ অগ্রসরমান বৈজ্ঞানিক খোঁজের আলোকে অবাস্তব এবং অপসৃয়মান যুগলে পরিণত হয় তারই তীক্ষ্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনা। এ বইটিতে গ্রিনব্ল্যাট মিল্টনের মহৎ সৃষ্টি প্যারাডাইস লস্ট আলোচনায় আনতে গিয়ে বলেন যে মিল্টনের নিজের জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে নানা পর্যায়ের মান–অভিমান, বিগ্রহ, গ্রহণ–বর্জন–গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে ছায়া ফেলেছে তাঁর আদম এবং হাওয়ার দাম্পত্যজীবন চরিত্রায়ণে।

ঠিক সে ভাবে কবি নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন থেকেও নজরুলের ইসলাম ধর্মকে বাংলাকরণের চিন্তার বীজ খুঁজে পাওয়া যায়। আমি বছর দুয়েক আগে নজরুলের চুরুলিয়া গ্রামে তাঁদের বসতবাটি দেখতে যাই। ভ্রমণার্থীর চোখ দিয়ে দেখে আমার মনে হয়েছে গ্রামটি একান্তই মুসলমান অধ্যুষিত, এবং সংস্কৃতিও ইসলামিক। মনে পড়ছে, নজরুলের বাড়ির সামনের রাস্তার উল্টোদিকের আরেক বাড়ির সীমানা দেয়ালের গাত্রে নজরুলের এমন একটি দীর্ঘ বাণী লেখা আছে, যেটা এর আগে আমি কোথাও পড়েছি বা দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। বাণীটি এখন মনে পড়ছে না, তবে যতটুকু মনে করতে পারছি, এটি ছিল নজরুলের মক্কা–মদীনায় শারীরিকভাবে গিয়ে হজ্বব্রত পালন করতে না পারার অনুতাপসংবলিত। অথবা এমনও হতে পারে যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত সাম্প্রদায়িক আবহে নজরুলের উত্তরসুরীরা নজরুলের মুসলমানিত্ব সবিশেষ প্রকাশ করার জন্য এ উক্তিটি বেছে নিয়েছেন।

নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমেদ নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। ইসলামের সকল পরব ও আচার তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তাঁর উদার মনোভাব ছিল। তিনি মারা যান নজরুলের বয়স যখন নয় বছর। কিন্তু পিতার কিছু বৈশিষ্ট্য নজরুলের মধ্যে থাকাই স্বাভাবিক। আবার নজরুলের এক চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিত। গ্রামের যে মক্তব থেকে নজরুল নিম্ন প্রাইমারি পাস করেন সেখানকার একজন শিক্ষক ছিলেন কাজী বজলে আহমেদ। এঁরা দু’জনই নজরুলকে আরবি–ফার্সি ও উর্দু শিখতে সাহায্য করেন। দেখা যায় অতি অল্প বয়সে লেটো দলের জন্য পালা রচনা করতে গিয়ে নজরুল একটি কবিতা লেখেন যাতে প্রচুর বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ দেখা যায়। কবিতাটি এরকম: ‘মেরা দিল বেতাব কিয়া / তেরী আব্রু য়ে কামান্‌ / জ্বলা যাতা হ্যায় / ইশ্‌ক মে জান পেরেশান / হেরে তোমার ধ্বনি / চন্দ্রকলঙ্কিনী / মরি কী যে বদনের শোভা / মাতোয়ারা প্রাণ / বুলবুল করতে এসেছে / তন্থ মধু গান।’ এ কবিতার মধ্যে যেমন অভিজাত সংস্কৃতিনির্ভর শব্দ ‘চন্দ্রকলঙ্কিনী’ আছে, তেমনি আছে ‘ইশক’, ‘পেরেশান’ ইত্যাদি ফার্সি শব্দ। কাজে ছোট বেলা থেকে বাংলা শব্দ এবং বিদেশি শব্দের মধ্যে যে সহজিয়া লেনদেনের ব্যাপারটি নজরুল প্রতিভা আবিষ্কার করে নিল, বলাবাহুল্য তিনি যতই পরিণতির দিকে এগিয়েছেন কবি এবং লেখক হিসেবে, ততই তিনি এ লেনদেনের প্রক্রিয়াটিকে একটি তাত্ত্বিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে লাগলেন। লেখক আহমদ ছফা তাঁর সুবিখ্যাত বাঙালি মুসলমানের মন গ্রন্থে এ তত্ত্বটি দাঁড় করান যে বাংলা সাহিত্যে মুসলমান বীরত্ব গাথা রচনার প্রয়াস মুসলমান লেখকেরা নিয়েছিলেন এবং সে জন্য তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বীর চরিত্রকে অভৌগোলিক ও ইতিহাসের শুদ্ধতা ছাড়া নির্মাণ করেন। ছফার দৃষ্টিতে বিষাদ সিন্ধু মহৎ সৃষ্টি হলেও, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক প্রমাদযুক্ত। মীর মোশাররফ হোসেনের পরে নজরুলের ইসলামী সংস্কৃতি নিয়ে উচ্ছ্বাস কম আকর্ষণীয় নয়। প্রথম জীবনেই সমরাক্রান্ত মানসিকতা ছিল তাঁর। ৪৯নং বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে তিনি তিনটি বছর করাচিতে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং কাজের ফাঁকে ফাঁকে আরবি ও ফার্সি সাহিত্য গিলে ফেলেন, যার মধ্যে প্রাগ্রসরতার কারণ ছিল তাঁর শৈশবে আরবি ও ফার্সি ভাষায় শিক্ষা লাভ। নজরুল যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন, সেজন্য ছফা কথিত মীর মোশাররফের ভুলগুলো তিনি করেননি, এবং একে একে রচনা করেন ‘আনোয়ার পাশা,’ ‘কামাল পাশা’– যেগুলো যুদ্ধের বাজ পড়ছে, গোলা ছুটছে সে রকম কবিতা, এবং এর কিছু পরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সৃষ্টি করলে তাতেও আগের দুই কবিতার মতো আরবি–ফার্সি–উর্দু শব্দের আনাগোনায় পুরো কবিতাটি কলরোলময় হয়ে ওঠে। যদিও লক্ষ্য করলে দেখা যায়, নজরুলের যত বিখ্যাত কবিতা আছে, তার মধ্যে ‘বিদ্রোহী’তে বরঞ্চ বিদেশি ভাষার প্রবেশ কম। ‘শির’ এবং ‘আরশ’ ছাড়া আর তেমন চোখে পড়ে না। কিন্তু কবিতার ছন্দটা যেন রণদামামার। সে তুলনায় ‘শাত্‌–ইল–আরব’ এবং ‘মোহর্‌রম’ কবিতার মধ্যে বিদেশি শব্দের প্রয়োগ বেশি দেখা যায়। ‘শাত–ইল–আরব’ এক কথায় কবির অনন্য সৃষ্টি কারণ কবি কখনো মেসোপোটেমিয়া যান নি, কিন্তু তাঁর মানসচক্ষে তিনি নদীটির বর্ণনা রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘কথা ও ছন্দ’ কবিতায় আছে দেবতা কবিবর বাল্মিকীকে বলছেন তুমি অযোধ্যা না দেখে থাকতে পার, তবে জেনে রাখ ‘কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ এটাও লক্ষ্য করলে দেখা যায় ‘শাত–ইল–আরব’ কবিতায় ঐসলামিক বীরত্বের জয়গাথা গাওয়া হলেও কিন্তু নদীটির ঠিক প্রাকৃতিক, স্থানিক এবং আবহাওয়াগত বর্ণনা নেই। সেদিক থেকে ‘মোহররম’ অনেক বেশি উৎরোনো কবিতা। এতে আরবি ফার্সি ভাষা মিশেছে আবার স্থানিক বর্ণনাও যথেষ্ট আছে। ভাষার মিশেল: ‘নীল সিয়া আস্‌মান, লালে লাল দুনিয়া, — / ‘আম্মা ! লা’ল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া।’ আর স্থানিক বর্ণনা: ‘কলিজা কাবাব—সম ভুনে মরু–রোদ্দুর, / খাঁ খাঁ করে কারবালা, নাই পানি খর্জুর।’

কবি নজরুলের জীবনে তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয়, দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের ১৯৩০ সালে মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে মৃত্যুর ঘটনা কবিকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে একান্ত দুর্বল করে ফেলে। অপরিসীম শোকে গান রচনা করেন, ‘আমার গানের বুলবুলি ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে।’ অধ্যাপক প্রীতি কুমার মিত্র তাঁর গ্রন্থ দ্য ডিসেন্ট অব নজরুল: পোয়েট্রি এ্যান্ড হিস্ট্রি (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৭) জানালেন মৃত্যুটি নজরুলের চেতনার জগতে গভীর রেখাপাত করে এবং তিনি বিপ্লবীর ভূমিকা থেকে আধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ পর্বে তাঁর সহায় হয় সঙ্গীত (১৯৩০–৪২)। অবশ্য এর পূর্ব থেকেই, বিশেষ করে কৃষ্ণনগরে বাসকালীন সময়ে (জানুয়ারি ১৯২৬–ডিসেম্বর ১৯২৯), এবং পুত্র বুলবুলের জন্ম থেকে (১৯২৬), নজরুল বাংলা গানে গজল আমদানি করে বাংলা সংগীতের নতুন দ্বার উদ্ঘাটন করেন।

ওপরের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায় নজরুল তাঁর বহু–ভাষিকতার ক্ষমতাকে একটি তাত্ত্বিক পরিণতি দিতে অগ্রসর হচ্ছিলেন। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্কচ্ছলে ‘বড়র পীরিতি বালির বাঁধ’ শীর্ষক প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখলেন, ‘বাঙলা কাব্য–লক্ষ্মীকে দুটো ইরানি ‘জেওর’ পরালে তার জাত যায় না, বরং তাঁকে আরও খুবসুরতই দেখায়।’ সেটি হলো বাংলা ভাষাকে যদি বিদেশি শব্দ দিয়ে ঋদ্ধ করা যায়, তা হলে বিদেশি ভাষায় বাঙালি মুসলমানেরা যে ধর্ম পালন করে সেটা যদি ভাষান্তর করা যায় বাংলায় তাহলে বাঙালি মুসলমান ধর্মের মূল আলোয় পৌঁছাতে পারবে। নজরুলের এ প্রচেষ্টাটি আমার কাছে খুব আশাব্যাঞ্জক তত্ত্ব বলে মনে হয়।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক; প্রাক্তন উপাচার্য, কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ