আজকের শিরোনাম :

সৃষ্টি সুখের উল্লাসে নজরুল

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৬ মে ২০১৮, ১৫:১১

দিলীপ কুমার বড়ুয়া, ২৬ মে, এবিনিউজ : অনবদ্য অনন্য এক শৈশবে মায়াময় ভোরের পাখির সুরসোহাগে দোলা লেগেছে মনবিতানে। ভোরে আদরের ঘুম ভাঙতো মায়ের আবৃত্তি শুনে। মায়ের কণ্ঠে উচ্চারিত হতো ভোরের কবিতার ছন্দবিলাস– আমি হবো সকাল বেলার পাখি/সবার আগে কুসুমবাগে উঠবো আমি ডাকি। অথবা প্রভাতী ছড়ায় সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাগিদ দিয়েছেন মায়ের আদর মাখা কণ্ঠ – ভোর হলো/দোর খোলো/খুকুমণি ওঠরে ! /ঐ ডাকে/জুঁই শাখে/ফুল খুকি ছোটরে! মায়ের কণ্ঠে ছড়া কবিতার ছন্দে বারম্বার আন্দোলিত হয়েছি। ভোরের পাখির মতো পরম উল্লাসে মায়ের সাথে ঘুম ঘুম চোখে কণ্ঠ মিলিয়েছি। সেই সময়ে আমার ভেতরে এক ধরনের উচ্ছ্বসিত আবেগের ফলগুধারায় ছন্দময় কবিতার পঙক্তি পাখা মেললো– আমরা যদি না জাগি মা/ কেমনে সকাল হবে/তোমার ছেলে উঠলে মাগো/রাত পোহাবে তবে। এইতো সাহসের কথা। এইতো এগিয়ে যাবার কথা। এইতো জাগরণের কথা। অন্যকে জাগিয়ে দেয়ার আহ্বান। সবার আগে জাগতে হবে আমাকেই। আমিই বা আমরাই যদি জাগতে না পারি অন্যরা জাগবে কিভাবে? কৈশোরে এ কথার ভেতরগত মর্ম বুঝিনি। তবু ভালো লেগেছে। আজ যখন বুঝি তখন আরো ভালো লাগে। আরো আনন্দ জাগে। কবিতাটি আমাকে অভিভূত করে তুললো। কবিতার ভেতর স্বপ্নগুলো হামাগুড়ি দিতে লাগলো। কবিতাটি আমার অস্তিত্বের সাথে গেঁথে গেছে সেই শৈশব কৈশোরেই। কবিতাটি পড়তে গিয়েই তাঁর নামটি চিরদিনের জন্য আত্মস্থ করেছিলাম। তাঁর কবিতা লিচুচোর, খুকী ও কাঠবিড়ালী, খাঁদু–দাদু ছন্দদোলায় আবৃত্তি করেছি বহুবার। যার কবিতায় এতো জাগরণী বার্তা, এতো শিশুতোষ অভিনিবেশ। তিনি এ উপমহাদেশে একজনই। কাজী নজরুল ইসলাম। কৈশোরে নজরুলকে অতটা উপলব্ধি করতে পারিনি। কিন্তু নজরুল যে একজন স্বাপ্নিক কবি এ কথা আবিষ্কার করেছি তাঁর সাহিত্যে অবগাহন করে। উপলব্ধির বাতায়নে আজো কবি নজরুল এর ছড়া কবিতার ছত্র মনে আবেশ ছড়ায়। শিশুর মতো নরম–কোমল মনের অধিকারী নজরুল সৃষ্টি করে গেছেন শিশুতোষ ছড়া, কবিতা। শিশু–কিশোরদের নিয়ে তাঁর বেশকিছু ছড়া, কবিতা, গল্প ও নাটিকা আছে। এসব লেখনীতে নজরুলের শিশুমানস উদ্ভাসিত। তাঁর কবিতায় এখনো শৈশব– কৈশোরের দিনগুলো ফিরে পাওয়ার বাসনায় পাগলপারা। আমাদের ভাবনার ভেতর নজরুল যেভাবে এতটা শিকড় বিস্তৃত করেছে তাতে নজরুল আমাদের বাঙালি সত্তায় অনাদিকালের জন্য আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে আছে। তিনি সতত আছেন আমাদের মনের মন্দিরে। অনুভবের ডালিতে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে তাঁর শুভ জন্মতিথিতে প্রণমি তাঁকে অমৃতমনে।

কৈশোরের দিনগুলোতে নজরুলের প্রতি যে আগ্রহ আমাকে আনন্দে উদ্বেলিত করেছে তা আমাকে আজো তাড়িয়ে বেড়ায়। তাঁর কবিতায় সমুখ পানে এগিয়ে চলার উন্মাদনা ছিল – চল চল চল/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল/নিম্নে উতলা ধরনীতল/অরুণ প্রাতের তরুণদল/. . . ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত

আমরা আনিব রাঙা প্রভাত, /আমরা টুটাব তিমির রাত/বাধার বিন্ধ্যাচল। কিংবা দ্রোহের রণঢঙ্কা – বল বীর-/বল উন্নত মম শির! /শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের শিশুতোষ ছড়া–কবিতার হাত ধরেই আমার কবিতার সরোবরে অবগাহন এবং কবিতা ভালোবাসতে শেখা। যখন একটু একটু করে বুঝতে শিখছি কবিতা , তখন ইচ্ছে ডানায় ভর করে অবলোকন করেছি সাহিত্যের চারপাশটাকে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁর চেতনার শিকড় প্রোথিত ছিল নবজাগ্রত বাঙালির মানস–মৃত্তিকায়। নজরুলের কবি চৈতন্যে তিনি বৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক সমাজের পরিবর্তে কল্পনা করেছেন শোষণমুক্ত সুষম সমাজের। অসত্য, অমঙ্গল, অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান। স্বদেশকে ভালোবেসে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, শোষণ–বঞ্চনা, সামাজিক বৈরিতার বিপক্ষে উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহ বাণী। নজরুলের বিদ্রোহী চেতনার ভেতর কাজ করেছে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি, মানবসত্তা, মানবকল্যাণ সর্বোপরি মানুষের শৃঙ্খল মুক্তির তীব্র বাসনা। যে বাসনা তাঁর আজন্ম লালিত দ্রোহকে চরম বিদ্রোহে পরিণত করেছে। বিদ্রোহের জয়ডঙ্কা বাজিয়ে রচনা করেছেন বিদ্রোহী কবিতার পর্ধিত শব্দমালা– মহা–বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত,/যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন–রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-/ অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ–ভূমে রণিবে না-/বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত/আমি সেই দিন হব শান্ত। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হবার পর গোটা উপমহাদেশে সবাই বিস্ময় প্রকাশ করেন। এর আগে কেউ এমন কবিতায় সাহসের এমন উচ্চারণ করার স্পর্ধা দেখাননি। বিদ্রোহী কবিতা লিখেই নজরুল রাতারাতি বিখ্যাত। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব প্রিয়। এ কবিতায় বিদ্রোহের আহ্বান প্রাণের ভেতর ঝংকার ওঠে, রক্তকণিকায় ঝড় ওঠে। তাঁর বিদ্রোহী সত্তা সমাজ বলয়ে ছন্দের দুরন্ত আবেগে, ভাষার উত্তাল তরঙ্গে আওয়াজ তোলে রোমাঞ্চিত শিহরণে– রুখে দাও– আছে যতো অনিয়ম, অনাচার, শৃঙ্খল। এক নিমেষেই নজরুল পরিণত হয়েছিল অজস্র মানুষের প্রিয়পাত্রে। ছোটবেলায় পিতাকে হারিয়ে দুখু মিয়া খ্যাত নজরুল অনেক দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে দিন যাপন করেছেন। তিনি জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছেন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। আজীবন দুঃখ কষ্টই ছিলো তাঁর পরম বন্ধুর মতো। যাকে গায়ে জড়িয়েই উপভোগ করেছেন জীবনের প্রতিটি ক্ষণ। বেঁচে থাকার সংগ্রামে লড়াই করেছেন অসম সাহসে। তাঁর লেখাপড়াও তেমন এগোয়নি। ছোটবেলা থেকেই অর্থ সংগ্রহ করতে হয়েছিলো। মক্তবে শিক্ষকতা করেছেন। মসজিদে আজান দিয়ে বেড়িয়েছেন। লেটোর দলে যোগ দিয়ে গান করেছেন, গান লিখেছেন। কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও জীবনকে বিচিত্রভাবে উপভোগ করেছেন। জীবন ও কমের্র কঠিনতম দিকগুলো তাঁকে আরও বেশি করে জীবনের সংজ্ঞা বোঝার মনন উন্মোচন করেছিল। একদিন তাঁর সৃষ্টিশীলতার নৈপুণ্যে তিনি বিদ্রোহী কবি খ্যাতিতে দীপ্তি ছড়ালেন। নজরুল অন্যায় ও অসংগতির বিরুদ্ধে করেছেন সোচ্চার প্রতিবাদ। তাঁর আছে অদম্য সাহস, দ্রোহ এবং প্রবল উত্তাপ। আরও আছে জীবনবোধের বৈচিত্র্যময় আনন্দ ক্ষেত্র বিনির্মাণের প্রবল স্পৃহা।

তিনি সাম্যের শুদ্ধ চেতনায় শুধু মানুষকে প্রলুব্ধ করেননি। অসাম্যের কদর্য রূপটিও তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন জীবনাভিজ্ঞতার আলোকে। হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য, ভেদাভেদ, উচ্চ নিচ শ্রেণি বিভাজনের ভয়াবহতা। যার ফলশ্রুতিতে অবলীলায় সৃষ্টি করেছেন অনন্য সব কবিতা,গান, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস। তাঁর বিদ্রোহী সত্তার অভ্যন্তরেও বহুমাত্রার ছড়াছড়ি। উপনিবেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, জাত–পাত ধর্ম এবং শ্রেণি বিভাজনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, কামার, কুলি, মজুর অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ে বিদ্রোহ, অসত্য, অসুন্দর অমঙ্গলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। সকল জড়তা–মূঢ়তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এসবই বার বার ধ্বনিত হয়েছে তাঁর লেখায়। তাঁর জীবন ও সৃষ্টিকর্ম বিধৃত হয়েছে মানসচৈতন্যের জাগরিত সত্তায়। যেখানে তাঁর প্রেমিক সত্তা বিদ্রোহী সত্তায় রূপান্তরিত হয়েছে প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশে। নজরুলের অনেক কবিতা–গানে বিদ্রোহের বাণী ধ্বনিত হলেও তাঁর প্রেমবিষয়ক কবিতা এবং গান ও প্রচুর। তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত করেছেন সত্য আর সুন্দরের পথে প্রেম, সাম্য আর দ্রোহের উত্তাপে। সকল শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয়ে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচনে জানিয়েছেন উদাত্ত আহ্বান। নজরুলের দ্রোহীচেতনার প্রকাশ বিদ্রোহীসহ অগ্নিবীণা এবং বিষের বাঁশির কিছু কবিতায়। নজরুল অবলীলায় সেই সাহসিকতার শব্দাবলিই ব্যবহার করছেন, এদের গূঢ় তাৎপর্যের কথা না ভেবেই – আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,/ আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়…/ জগদীশ্বর–ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম . . .

প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি’। তিনি আরো বলেছেন – আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। সুনির্দিষ্ট কোন ধর্ম, দর্শন কিংবা জীবনচর্যায় তিনি নিজেকে বেঁধে রাখেননি। সকল ধর্মের সকল মানুষের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস। তাই তিনি বাংলা ও বাঙালির কবি।

নজরুল তাঁর কাব্য সৃজনের ক্যানভাসে ঐতিহ্য সচেতনতা, লোকজজীবন, আনন্দ, বেদনা , প্রেম– বিরহ, সাম্য, মানবিকতা ও দ্রোহের সম্মিলনে অপরূপ চিত্র এঁকেছেন। নজরুল বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতায় অমানবিক বৈষম্য, পাশবিক সাম্প্রদায়িকতা, নির্মম শোষণ আর ব্রিটিশের নজিরবিহীন অত্যাচার–অপশাসনের অধীনতায় বাধ্য হয়ে সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এক ব্যতিক্রমী সাহসিক আকাঙক্ষায়। অমরতার আকাঙক্ষা নিঃসঙ্কোচে পরিহার করে তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন মানবিক দুঃখ, কষ্ট ও বিপর্যয়কে। এজন্যই তিনি তার সবটুকু সাধ্য উজাড় করে দিয়ে বৈষম্যহীন এক মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার চেতনায় সৃষ্টি করেছেন সাহিত্য, গান প্রেমে এবং দ্রোহে। শোষণ–বঞ্চনা, সামাজিক বৈরিতার বিপক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছেন। মানবিক স্বপ্নালোকের অস্তিত্ব অন্বেষা তাঁর কবিতার প্রধান শক্তি। কবির অনুভূতি আনন্দ–বেদনা বিষণ্নতাকে ছুঁয়ে স্পর্শ করে মানবিক বোধ। কবিতার বিষয় থেকে উঠে এসেছে নির্মাণ কুশলতা। প্রবল আবেগ–উদ্দীপ্ত নজরুল যে পটভূমি ও প্রেরণায় কবিতা লিখলেন এবং জ্বালাময়ী গদ্য নিবন্ধ, রচনা লিখলেন তাতে অগ্নিই হয়ে উঠল তাঁর মুক্তিমন্ত্র, দেশের জন্য গণমানুষের জন্য। তিনি অসাধারণ এক প্রাণশক্তিতে শৈল্পিক উৎকর্ষে সাহিত্য ভাণ্ডারকে অতুলনীয় ঐশ্বর্য ও সম্পদে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, কারার ঐ লোহ কপাট/ভেঙে ফেল কর রে লোপাট/রক্ত জমাট/শিকল পূজায় পাষাণ বেদী/ওরে ও তরুণ ঈশান/বাজা তোর প্রলয় বিষাণ/ধ্বংস নিশান/উড়ুক প্রাচীর/প্রাচীর ভেদি’। সাহসী কাব্য লেখনীর মাধ্যমে এ দেশবাসীকে জাগিয়েছেন। পরাধীনতা, শোষণের কবল থেকে জাতিকে প্রথম স্বাধীন হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। নজরুলের কাছে আরাধ্য থেকেছে মানুষ। নজরুল ভালোবেসেছিলেন মর্ত্যের মাটি আর মানুষকে। এই মর্ত্যের মাটি–মানুষের প্রতি গভীর প্রেমকে ঘিরেই নজরুলের সারা জীবনের সব আয়োজন আবর্তিত। গভীর মানবতাবোধই ছিল তাঁর অন্তর্গত দায়বদ্ধতা ও অনুপ্রেরণার উৎস। মানুষকে গভীরভাবে ভালোবেসেছিলেন বলে সমকালীন স্বদেশের পরাধীন জনসাধারণের ওপর ভিনদেশী বণিক–শাসক ইংরেজের অমানবিক জুলুম–নির্যাতন, অত্যাচারে ব্যথিত হয়ে ডাক দিয়েছেন বিদ্রোহের।

নজরুলের আবির্ভাব ধূমকেতুর মতোই চিরবিস্ময়কর। সৃষ্টির ক্ষেত্রে ছিলেন আজীবন গভীর নিমগ্ন এক স্রষ্টা। তিনি বাংলা সাহিত্য এবং সঙ্গীতের মধ্যগগনে আবির্ভূত হয়ে পুরো আকাশকে আলোকময় করেছেন। রাবীন্দ্রিক বলয় পেরিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক স্বতন্ত্র সার্বভৌম শিল্প সাম্রাজ্য। রবীন্দ্র যুগে রবীন্দ্র বলয়ের বাইরে গিয়ে নতুন ধারার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা তাঁকে কালের পরিক্রমা ছাড়িয়ে মহাকালে নিয়ে গেছে। নজরুলের কবিতা পড়লে বা অন্য ধরনের রচনায় মনে হবে যে সমকাল সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। আবার কখনো মনে হয় তিনি তাঁর সৃজনশীল মণিমুক্তো নিয়ে সমকালকে অতিক্রম করে দাঁড়িয়ে আছেন চিরকালের দোরগোড়ায়।

নজরুল বাঙালির ঐতিহ্যিক অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রেম ও দ্রোহ মিশিয়ে সৃষ্টি করেছেন তাঁর কাব্যের অনন্যসাধারণ সৃজনশীল ক্ষেত্র। বাংলা সাহিত্যে তিনি নিজস্ব মনস্বীতায় সৃষ্টি করেন তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ অগ্নিবীণা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যথার দান, মৃত্যু ক্ষুধা। সৃষ্টিশীল রচনার মাধ্যমে কবি নজরুল বাঙালির মননে জায়গা করে নেন আপন মহিমায়। বিদ্রোহী, আপনভোলা, অতি সহজ–সরল, দরদি ও নিরহংকারী এবং জীবনভর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামী কবিকে আমরা বাংলা সাহিত্যে পেয়েছি বহুমাত্রিক, বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী হিসেবে। শত প্রতিকূলতা, শত বিরোধিতা, শত সমালোচনা, নিরুৎসাহ, ভৎর্সনা, প্রতিবন্ধকতা– কোনো কিছুতেই তাঁর প্রতিভা দমে যায়নি। তাঁর সৃষ্টির দীর্ঘ অবিশ্রান্ত পথ চলায় নিরবচ্ছিন্ন সাহিত্য সাধনা, মেধা ও শ্রমে নিজেই ক্রমাগত নিজেকে অতিক্রম করেছেন। তিনি আমাদের চৈতন্যে, চিন্তায়, সংস্কারে, মননে মিশে আছেন।

আজকে কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা, সাম্প্রদায়িকতা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা যখন একটি বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নির্মাণে স্বাপ্নিক উচ্ছ্বাসে মহাকাশ জয়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এগিয়ে যাচ্ছি, তখন কবি নজরুল আরো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। আমাদের নানাবিধ সঙ্কটে প্রধান প্রেরণার উৎস হয়ে বিরাজ করছেন নজরুল। তাঁর বিদ্রোহী চেতনা আমাদের জড়তা ও হতাশাকে দূর করে প্রতিনিয়ত সাহস যুগিয়ে যাবে। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষকে সদা–সর্বদা জাগ্রত ও উজ্জীবিত হতে প্রেরণা জোগাবে। নজরুলের অসামান্য সৃষ্টিগুলো সাহিত্য জগতে অনির্বাণ ও অমর হয়ে আছে। আজ তাঁর জন্মদিনে জেগে উঠুক আবার সেই চির চেনা আবেগময়ভাবের উদ্দাম প্রবাহে দ্রোহী কণ্ঠের শাণিত উচ্চারণ – চির বিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!

লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক; রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত), ইউএসটিসি
(সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ