আজকের শিরোনাম :

সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধা

ম্যাক্সিম গোর্কি : সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের অমরস্রষ্টা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২২ মে ২০১৮, ১৭:০৭

কানাই দাশ, ২২ মে, এবিনিউজ : বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ ও অত্যাচারী সামন্ত শাসক জার বংশের দুঃসহ দুঃশাসনে ঊনবিংশ শতাব্দীর রাশিয়ার মানুষ যখন ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে পশ্চাদপদ অবস্থানে তখন রুশ শিল্প সাহিত্য এক অভাবনীয় অগ্রগতির পথে এগিয়ে যায় বিশেষ করে মানুষের দুঃখ–গ্লানি, অসহনীয় নিপীড়ন আর তা থেকে উত্তরণের পথ ও প্রতিরোধের কাহিনী নিয়ে – লেখা হতে থাকে অবিস্মরণীয় সব উপন্যাস। বস্তুত বিশ্বের উপন্যাস সাহিত্যের এক অসাধারণ প্রকাশ আমরা দেখতে পাই রুশ সাহিত্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরো সময় জুড়ে। তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, গোগল, চেখভ প্রমুখ বিশ্বখ্যাত ঔপন্যাসিকদের অবদানে শুধু রুশ সাহিত্য নয় ঋদ্ধ হয়ে উঠে বিশ্বসাহিত্য। বলা হয়ে থাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রথম পাঁচটি উপন্যাসের মধ্যে তলস্তয়ের “ওয়ার এণ্ড পিস ও আন্না করেনিনা”–এ দুটো উপন্যাসকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। দস্তয়েভস্কি, চেখভ, গোগল, শোলোকভ বিশ্বের প্রথম সারির ঔপন্যাসিক হিসাবে বিবেচিত। পুশকিন একজন কবি ও ঔপন্যাসিক হিসাবে রুশ সাহিত্যের ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের অগ্রজ ও প্রতিভাধর হলেও উপন্যাস সাহিত্য তাঁর পরবর্তীদের হাতেই সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়। প্রচণ্ড প্রভাবশালী অর্থোডক্স চার্চ ও জারের মিলিত নিপীড়নে নিপীড়িত রাশিয়ার মানুষ ভাষা খুঁজে পায় এঁদের উপন্যাসে। আর দারিদ্র্য, বঞ্চনা, অসহায়, অনিশ্চিত পরিবেশে নানা ঘাত প্রতিঘাতে বড় হয়ে উঠা এঁদের অনুজ মাত্র ১১ বছর বয়সে এতিম হয়ে যাওয়া ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার হিসাবে দস্তয়েভস্কির মত আলোর অন্বেষায় সমাজ ও জীবনের অন্ধকারকে তুলে ধরে ম্যাক্সিম গোর্কির রুশ সাহিত্যে বৈপ্লবিক আবির্ভাব একটি চমকপ্রদ ঘটনা। তাঁর শৈশব–কৈশোরের যাপিত সংগ্রাম মুখর, দারিদ্র্য–পীড়িত জীবনের সাথে মিলে যায় বাংলা সাহিত্যের দুখু মিয়া খ্যাত নজরুলের জীবন ও সাহিত্যবোধ। দুঃখ–যন্ত্রণা আর সংগ্রামের অবিমিশ্র অভিজ্ঞতার মহাকাব্যিক আখ্যান ১৯০৬ সালে রচিত “মা” উপন্যাস গোর্কিকে বিশ্বসাহিত্যের আলোকোজ্জ্বল মঞ্চে স্থান করে দেয়।

জাতীয় জীবনের এক ঝঞ্জা মুখর সময়ে রাশিয়ার নিঝনি নভগোরোদ অঞ্চলের এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৮৬ সালের ১৮ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন অ্যালেক্সিন ম্যাক্সিসোভিচ পেশকভ, যিনি পরবর্তীতে ম্যাক্সিম গোর্কি এই ছদ্ম নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হন। পরবর্তীতে গৃহীত তাঁর এই ‘গোর্কি’ নামটি তাঁর জীবনের সাথে মিলে যায়। কেননা “গোর্কি” শব্দের অর্থই হল “তিক্ত”। ১১ বছরে এতিম হয়ে যাওয়া ম্যাক্সিসোভিচ পেশকভের কাছে জীবনটা ছিল তিক্ত অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। মা মারা যাবার পর এতিম গোর্কি সে বয়সেই কাজ নেন জুতার দোকানে। পরে এক জাহাজের খালাসিদের বাসন ধোয়ার কাজ নেন তিনি। সেই জাহাজের এক নাবিক তাঁকে বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। দিন রাত খাটুনির পরে তিনি গভীর রাতে পাঠাভ্যাস করতেন। সেই যে বই পড়ার উৎসাহ ও অভ্যাস তাঁর গড়ে উঠল তাতে ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে মনে মননে অনেকখানি পাল্টাতে পারলেন। আমৃত্যু বজায় ছিল তাঁর পাঠাভ্যাস জীবন সংগ্রামে হতাশ হয়ে ১৯ বছর বয়সে এক রাতে নদী তীরে গিয়ে নিজের বুকে গুলি করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে নীত হন ও পরবর্তীতে কোন রকমে বেঁচে যান। পরে আবার জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কাজ নেন এক রুটির দোকানে। বাস্তবজীবনের কষ্ট আর পরিশ্রমকে মেনে নেন নিত্য সঙ্গীর মত। ঐ সময়ে রাশিয়ায় চলছিল জারের রাজত্ব আর নির্যাতন আর তা প্রতিরোধে নানা জায়গায় বিপ্লবীরাও সংগঠিত হচ্ছিল গোপন দলে। এমনি একটি গোপন বিপ্লবী দলের সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। এতে যুক্ত হয়েই তিনি পরিচিত হলেন মার্কসীয় সাহিত্যের সাথে। তিনি এতে লাভ করলেন এক নতুন বিশ্ববীক্ষা। পরে রেলের পাহারাদারির কাজ নিয়ে ফিরে আসেন নিজের জন্মস্থান নিঝনি নভোগরাদে। এ সময়ে তিনি কিছু কবিতা রচনা করেন। নাম দেন “পুরনো ওকের গান”। ইতোমধ্যে পুরনো বিপ্লবীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ও দু’বছর তিনি কারাভোগ করেন। তিনি পরে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। ১৮৯৮ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ “এসেজ এন্ড স্টোরিজ” প্রকাশিত হলে সাহিত্যিক হিসাবে বিশেষ করে নাট্যকার ও গল্প লেখক হিসাবে তাঁর খ্যাতি সারা রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অবশ্য এ সময়ে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, মার্কসবাদী পাঠচক্র ও রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন ও ১৯০২ সালে লেনিনের ব্যক্তিগত বন্ধুতে পরিণত হন। সে বছর লেখেন বিখ্যাত নাটক “দি লোয়ার ডেপথস”। এ সময়ে আরো বেশ কিছু জনপ্রিয় নাটক রচনা করেন। রুশ সমাজের নীচু তলার ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কঠিন ও দ্বন্দ্বমুখর দুঃসহ জীবন ফুটে উঠে তাঁর এ সব নাটকে। বস্তুত সমাজ সচেতন ও দ্রোহী সাহিত্যিকরা সাধারণত তাঁদের হাতিয়ার হিসাবে বেছে নেন নাটক ও উপন্যাস। ১৯০৫ সালের বৈপ্লবিক গণঅভ্যুত্থানের পরে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন। মাদাম কুরি ও আনাতোল ফ্রাঁসসহ ইউরোপ জুড়ে বুদ্ধিজীবী, কবি ও শিল্পী সাহিত্যিকদের প্রতিবাদের মুখে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯০৬ সালে বলশেভিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে অর্থ সংগ্রহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। ১৯০২–৩ সালের দিকে খসড়া হিসাবে লিখিত ‘মা’ উপন্যাসটি তিনি জাহাজে বসে সম্পূর্ণ করেন। সে বছরই তিনি ইতালির ক্যাপ্রিতে চলে আসেন এবং রুশ সম্রাটের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া ফিরতে না পেরে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত সেখানে বাস করেন। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পূর্বাপর সময়ে তিনি রাশিয়ায় থেকে বিপ্লবের নানা কাজে অংশ নেন। পেত্রোগাদে তাঁর বাড়ী তখন কার্যত বলশেভিকদের প্রধান আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত হয়। অবশ্য বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সরকার ও রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে লেনিনের সাথে তাঁর মতভিন্নতা দেখা দেয় এবং মাঝেমধ্যে তা তীব্র আকারও ধারণ করে। বিশেষত সরকারি দমন নীতির মাত্রা নিয়ে গোর্কি অসন্তুষ্ট ছিলেন। ১৯২১ সালে তাঁর দেহে যক্ষ্মা ধরা পড়ে এবং আবারও তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান। তিনি ইতালির সরেন্টোতে বেশ কয়েক বছর কাটান। এ সময়েই তিনি প্রচুর লেখালেখি করেন ও ‘পৃথিবীর পথে’, ‘পৃথিবীর পাঠশালা’ ও ‘আমার ছেলেবেলা’ এ তিনখণ্ডে তাঁর আত্মজীবনীর বিখ্যাত ট্রিলজি শেষ করেন। ঐ ট্রিলজি বিশ্বসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। এ সময়ে এক নতুন গল্প সংগ্রহও প্রকাশিত হয়। ১৯২৮ সালে সারা রাশিয়া ও ইউরোপে তাঁর ৬০তম জন্মবার্ষিকী মহাসাড়ম্বরে পালিত হয়। স্ট্যালিনের আমন্ত্রণে সে বছর তিনি রাশিয়া ফিরে আসেন। ১৯৩২ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরষ্কার ‘অর্ডার অফ লেনিন’ এ ভূষিত করা হয়। এ উপলক্ষে মস্কোর একটি সড়ক ও তঁাঁর জন্মস্থান নিঝনি নভগোরেদের নাম পাল্টে তাঁর নামে নামকরণ করা হয়। ১৯৩৪ সালে সোভিয়েত লেখক ও শিল্পী সংঘের প্রধান করা হয় তাঁকে। সেই বছরে অনুষ্ঠিত লেখক ও শিল্পী সংঘের প্রথম কংগ্রেসে বক্তৃতায় তিনি শিল্প সাহিত্যে নূতন ধারা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদ বা সোশ্যালিষ্ট রিয়ালিজমের কথা প্রথম উত্থাপন করেন। ১৯৩৬ সালে ১৮ জুন ৬৮ বছর বয়সে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান হয়। শেষ শ্রদ্ধা হিসাবে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ক্রেমলিন প্রাসাদে সমাহিত করা হয়।

ম্যাক্সিম গোর্কির আনুষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছিল না। তিনি ছিলেন অনেকটা স্বশিক্ষিত। নিয়তির নিষ্ঠুর চাবুকে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে তাঁর অন্তরাত্মা। এ দুঃসহ অবস্থা কাটিয়ে বিপ্লবী প্রত্যয় ও নিছক অধ্যবসায়ের জোরে তিনি হয়ে উঠেছেন জননন্দিত একজন লেখক, সমাজ সচেতন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, বিপ্লবী রাশিয়ার অন্যতম স্থপতি, নতুন ধারার সাহিত্য তথা সর্বহারা নন্দনত্ত্বের অবিসংবাদিত প্রবক্তা। সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের শর্টলিস্টে পাঁচবার তাঁর নাম অন্তর্ভূক্ত হয়।

গোর্কি পৃথিবীর পথে পথে ঘুরেছেন, পৃথিবীর পাঠশালা থেকে নিয়ত পাঠ গ্রহণ করেছেন। মানুষের দুঃখ কষ্টের বাস্তবোচিত ছবি এঁকেছেন সাহিত্যে, দিয়েছেন ভবিষ্যতের দিশা। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত গল্প “মাকার চুদ্রা” প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তিনি লেখক হিসাবে রাশিয়াতে খ্যাতি অর্জন করেন। একজন চোর ও এক কৃষক বালককে নিয়ে ১৮৯৫ সালে লেখা গল্প “চেলকাশ” তাকে লেখক হিসাবে জনপ্রিয় করে তোলে। সেই সময়ে সুনির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক বোধ ও মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি না থাকা সত্ত্বেও তিনি আপন অভিজ্ঞতা থেকে খেটে–খাওয়া সমাজের নীচু স্তরের মানুষদের তাঁর গল্প নাটকে নিয়ে আসেন। তাদের তিনি তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য করে তুলেন। এছাড়াও তাঁর বিখ্যাত সাহিত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত নাটক ‘দি লোয়ার ডেপথস’ বা নীচ তলার মানুষ (১৯০), “চিলড্রেন অফ দি সান” ইত্যাদি। “টুয়েন্টি সিক্স ম্যান এন্ড এ গার্ল”, “দি সং অফ দি স্টর্মি পেট্রোল”, আত্মজীবনীর বিখ্যাত ট্রিলজি, জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস “দি মাদার” ইত্যাদি। জীবনের একেবারে শেষের দিকে ১৯৩১ সালে তিনি তাঁর সদ্য সমাপ্ত রূপকথার গল্প “এক বালিকা ও তার মৃত্যু” তিনি স্ট্যালিন, মলোটভ প্রমুখ তৎকালীন পার্টি ও সরকারের শীর্ষ নেতাদের সামনে পড়ে শোনান। পাঠ শেষে যাবার সময় বইয়ের শেষ পাতায় স্ট্যালিন মন্তব্যে লেখেন– ‘এ লেখাটি গ্যাটের ফাউস্টের চাইতেও উৎকৃষ্ট হয়েছে।” এভাবেই সক্রিয় বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা ও অবিনশ্বর সাহিত্য সৃষ্টির জন্য তিনি সারা জীবন সোভিয়েত রাষ্ট্র ও জনগণের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও সম্মান অর্জন করেছেন। মানব মুক্তির সংগ্রামে জীবন নিবেদিত করে যাপন করেছেন সার্থক এক জীবন। সারা জীবন তিনি অসংখ্য চিঠি লিখেছেন যা, ব্যক্তি গোর্কির জীবন ভাবনায় সমৃদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের মতই গোর্কির পত্র সাহিত্য অনন্য বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর। এ পর্যন্ত বিশ হাজারের ও অধিক চিঠি পাওয়া গেছে। অনাবিষ্কৃত আরো কয়েক হাজার চিঠি থাকতে পারে। রুশ বিপ্লবের পূর্বাপর সময়ে ইউরোপের এমন কোন মনীষী নেই যাঁর সাথে গোর্কির পত্রালাপ হয়নি। এ চিঠিগুলো নিশ্চয়ই রুশ সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

গোর্কির মতে সাহিত্য মূলত দু’টি ভাবধারার সমন্বয়ে বিকশিত হয়ে উঠেণ্ড বাস্তবতাবাদ রোমান্টিসিজম। তিনি বাস্তবতাবাদের নামে সাহিত্যে প্রচার ধর্মী রাজনৈতিক ফটোগ্রাফিতে যেমন বিশ্বাস করতেন না, তেমনি রোমান্টিসিজমের নামে বাস্তবতা বিচ্যুত কাল্পনিক জগতের সাহিত্যিকদের কাজ পছন্দ করতেন না। তিনি তাঁর পূর্বসুরী দস্তয়েভস্কির কিছু কাজের সমালোচনা করেন এ বলে যে, ‘দস্তয়েভস্কির মধ্যে বাস্তবতাবোধ থাকা সত্ত্বেও ছিল নিষ্ক্রিয় রোমান্টিক কল্পনার প্রচ্ছায়া যা তাঁকে যুক্তিবিরোধী খৃষ্টীয় পাপবোধ ও পরিত্রাণবাদের দিকে নিয়ে যায়। মানুষের প্রতি দরদ, জার ও পুরোহিততন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে আজীবন সংগ্রামী, নৈতিকতা, বিশ্বমানবতা, প্রগতিমুখীন শিল্পরীতি ও জীবন ঘনিষ্ট বাস্তবতাবোধের জন্য তলস্তয়কে গোর্কি রুশ সাহিত্যের এক অতুলনীয় যুগন্ধর সাহিত্য স্রষ্টা রূপে বিবেচনা করেছেন, দীপ্তিমান একজন জাতীয় লেখক হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ১৯০৯ সালে লেখা ’কদণ ঊধ্রধর্ভণথরর্টধমভ মত যণর্রমভটফর্ধহ’ নামক সমালোচনা গ্রন্থে তিনি তাঁর নিজস্ব সাহিত্য ভাবনাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করেন। গোর্কি মনে করতেন অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাহিদাই মানুষের মনে শিল্পবোধের সৃষ্টি করে। শ্রমই হল সৃষ্টিশীলতার মূল উৎস। গোর্কি আরও বলেন, “ শিল্পী হলেন তাঁর দেশের ও শ্রেণির ভাবপ্রবণ মুখপাত্র– তাঁর কালের কণ্ঠস্বর। অতীতকে তিনি যত বেশি জানবেন, তত গভীরভাবে তিনি বর্তমানকে আমাদের যুগের বিপ্লবী বিশ্বচেতনাকে উপলব্ধি করতে পারবেন।” এ সব কথা থেকে নিশ্চয়ই আমরা বুঝতে পারি কলাকৈবল্যবাদ বা শিল্পের জন্যই শিল্প নয়, দেশের জনগণের কাছে অবশ্যই শিল্পীর দায়বদ্ধতা রয়েছে। শ্রেণি সচেতন গোর্কি মনে করতেন শিল্প ও শ্রমের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সাহিত্যের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর মতে সুন্দরের উৎস হল মানুষ ও তার সৃজনশীলতা। সংস্কৃতির ইতিহাস হলণ্ড শ্রেণি সমূহের বিকাশ, শ্রেণি সংগ্রাম ও শ্রেণিগত বিরোধ ও অসামঞ্জস্যের এক বাস্তব ও তথ্য নির্ভর ইতিহাস। একইভাবে তিনি বলতেন সমষ্টির সক্রিয়তাই জন্ম দিয়েছে সংস্কৃতির। যুগে যুগে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন শ্রেণির নিজস্ব সংস্কৃতি। নিপীড়িত ও শ্রমজীবী মানুষের সংস্কৃতির বিকাশ প্রাচীনকাল থেকেই শাসক শ্রেণির বাধার মুখে পড়েছে। শ্রমই সংস্কৃতির প্রধান সংগঠক, এই শ্রমই সব ধরনের ধারণার স্রষ্টা। শ্রেণি সচেতন সংস্কৃতি কর্মী হিসাবে গোর্কির গল্পে–উপন্যাসে, সাহিত্য ভাবনায় নিপীড়িত মানুষে প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল সরাসরি ও সুস্পষ্ট।

গোর্কির সাহিত্য ভাবনা প্রসঙ্গে আমরা আগেই বাস্তবতাবাদ ও রোমান্টিসিজমের কথা উল্লেখ করেছিলাম। বাস্তবতা বলতে প্রকৃতির সরাসরি অনুকরণ বা ন্যাচারেলিজম এ গোর্কি বিশ্বাস করতেন না। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইউরোপে বাস্তবতা বলতে একেবারে মন শূন্য বাহ্যিক বাস্তবতাকে বুঝাত। গোর্কি সে যান্ত্রিক বাস্তবতার পক্ষে ছিলেন না। অন্যদিকে তিনি রোমান্টিসিজমকে শুধু কল্পনা সর্বস্ব বাস্তব পরিবেশ বিবর্জিত সাবজেকটিভ কোন বিমূর্ত ধারণা বলে মনে করতেন না। তিনি রোমান্টিসিজমকে দুই ভাগে ভাগ করেনণ্ড নিষ্ক্রিয় ও সক্রিয় রোমান্টিসিজম। নিস্ক্রিয় রোমান্টিসিজম জীবন ও মনকে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে শিল্পীকে অন্তর্মুখী ও অন্তর্জগতমুখী করে তুলে ধরে। এটা কান্টীয় সৌন্দর্যতত্ত্বের কাছাকাছি ধারণা। কান্ট কল্পনা শক্তির মহিমা প্রচার করে সুন্দরকে বস্তুনিরপেক্ষ, জাগতিক সম্পর্কশূন্য বিশুদ্ধ আনন্দরূপে বিচার করেন। গোর্কি কান্টের সৌন্দর্যতত্ত্ব বা নিষ্ক্রিয় রোমান্টিসিজমের তীব্র বিরোধী ছিলেন। অন্যদিকে তাঁর মতে সক্রিয় রোমান্টিসিজম বাস্তব জীবনের বঞ্চনা ও অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে লেখককে প্রাণিত করে কলম ধরতে এবং এ ধরনের রোমান্টিসিজম জীবনকে অর্থবহ ও সুন্দর করার প্রেরণা দেয়, কেননা বেঁচে থাকার প্রেরণা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষকে তা উদ্দীপ্ত করে। তলস্তয়, চেকভ, টুর্গেনিভ এঁদের আমরা কি শুধুই রিয়ালিস্ট বা শুধুই রোমান্টিক বলব নাকি এ দুই ধারার সম্মিলিত মানবিক ও কল্যাণকামী আদর্শের প্রতিনিধি বলব। গোর্কি বলেছেন শক্তিশালী লেখকদের মধ্যে রোমান্টিসিজম ও রিয়ালিজম ওতপ্রোতভাবে মিশে থাকে। এ প্রসঙ্গেই আসে গোর্কি প্রবর্তিত সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজম বা সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রত্যয়ের ধারণা।

১৯৩৪ সালে মস্কোতে অনুষ্ঠিত সোভিয়েত লেখক ও শিল্পী সংঘের প্রথম কংগ্রেসে তাঁর বক্তৃতায় গোর্কি সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের ধারণা প্রদান করেন। সংক্ষেপে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের মূল কথা হল বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বাস্তবের পুনঃপ্রকাশ, ভবিষ্যত লক্ষ্য মাথায় রেখে অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত। ঐ সময়েই তিনি ক্রিটিকাল ও সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজমের পার্থক্য স্পষ্ট করেন। তাঁর মতে ক্রিটিকাল রিয়ালিজম বা বিচারি বাস্তবতার লেখকরাও বাস্তবতার কথা বলেন তবে তাঁরা বর্তমানের সমালোচনা করেন অতীতের নিরিখে। একধরনের নস্টালজিয়া বলা যায় তাঁদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জীবনযুদ্ধে ব্যর্থ ও বিচ্ছিন্ন হয়ে এঁরা বিপ্লবী পরিবর্তন ও ভবিষ্যতকে অবশেষে অ্যাবসার্ড বলে মনে করেন। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদীর দৃষ্টি ভবিষ্যতের দিকে প্রসারিত। তাঁরা পৃথিবীর বর্তমান বাস্তবতাকে শুধু তুলে ধরেন না তাকে পাল্টে দিয়ে প্রোজ্জ্বল ভবিষ্যতের কাছে নিয়ে যেতে চান। গোর্কির মতে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের চারটি বৈশিষ্ট্যণ্ড কর্মসূচি, সমষ্টিবদ্ধতা, আশাবাদ ও শিক্ষামূলকতা। তিনি বলেন জীবন হচ্ছে সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ। এ সম্পর্কে তাঁর বহুল উদ্ধৃত বক্তব্য হলণ্ড ”ওমডধটফর্ধ্র রণটফধ্রব যরমডফটধব্রর্ দর্ট ফধতণ ধ্র টর্ডধমভ. উরণর্টধশর্ধহ ষদম্রণ টধব ধ্রর্ দণ লভতর্র্ণণরণঢ ঢণশণফমযবণর্ভ মত বটভৃ্র বর্ম্র শটফলটঠফণ ধভঢধশধঢলটফ টঠধফর্ধধণ্র তমর দধ্র শধর্ডমরহ মশণরর্ দণ তমরডণ্র মত ভর্টলরণ” আমরা বাংলা সাহিত্যে সুকান্তের “নবান্ন” বা সুভাষের “মে দিনের কবিতা”কে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে নিতে পারি। ‘মে দিবসের কবিতা’য় সুভাষ লিখছেন –

‘চিমনির মুখে শোনো সাইরেন শঙ্খ

গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে ,

তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য

জীবনকে চায় ভালবাসতে’

সংগ্রাম ও মৃত্যুর মুখে জীবনকে ভালবাসা এবং আশাবাদের প্রতিধ্বনি আছে এ কবিতায়। সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের এ ধরনের আরো অনেক উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, সুভাষ প্রমুখ কবি ও লেখকদের কবিতা ও গল্প থেকে তুলে আনা যায়।

সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতাবাদের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসাবে আমরা গোর্কির “ম্যাগনাম ওপাস” জগদ্বিখ্যাত “মা” উপন্যাসের কথা বলতে পারি। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাশিয়ার শ্রমজীবীদের পাড়ায় পাড়ায় জীবন ছিল কঠিন ও ধুসর। কারখানা কর্তৃপক্ষের নিয়মের অধীনেই সেখানকার জীবন ও মনন আবর্তিত হত। শ্রমজীবীদের জীবন ছিল একঘেঁয়েমি বিষাদে ভরা। যাপিত জীবন তাদের সামনে তুলে ধরত এক হতাশাপূর্ণ অন্ধকার ভবিষ্যতের ছবি। এখানেই একদল যুবক খোঁজ পায় মুক্তির ঠিকানা, আলোর আভাস। তারা গোপন বিপ্লবী দলের সাহচর্যে এসে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন বুনে, সে বার্তা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে রাশিয়ার নানা প্রান্তে। অন্যদিকে জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর অভাবের সংসারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ক্রমে ধ্বস্ত হয়ে পড়া পেলাগেয়া নিলভনা নামে এক “মা” জেগে ওঠেন তাঁর অত্যন্ত আদরের ধন ছেলে পাভেল ভ্লাসভের বিপ্লবী কর্মতৎপরতায়– যে নিজেকে সেই গোপন বিপ্লবী দলের সাথে ইতোমধ্যে যুক্ত করে । পেলাগেয়া নিজেকে ছেলের বিপ্লবী ধ্যান ধারণায় ঋদ্ধ করে একটি সমতাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করেন। প্রতিবিপ্লবী রক্ষীদের নির্মম অত্যাচারে তাঁর করুণ মৃত্যুই শুধু পেরেছে বিপ্লবী সংগ্রাম থেকে তাঁকে নিরস্ত করতে। প্রতিক্রিয়ার লেলিয়ে দেয়া অবোধ ঘাতকদের প্রতি তাঁর প্রত্যয় দীপ্ত শেষ উচ্চারণ ”চমল যমমর, রমররহ ডরণর্টলরণ্র…………..” মা এবং মাতৃভূমি রাশিয়ার বিবর্তনের এক বিপ্লবী স্মারক এ উপন্যাস। এখানে মা ও ছেলের সম্পর্ক মূল উপজীব্য হলেও এতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য তৈরি হতে থাকা রাশিয়ার তখনকার অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি বস্তুনিষ্ঠভাবে এ উপন্যাসে গোর্কি তুলে ধরেছেন পরম নিষ্ঠার সঙ্গে। এ একটি উপন্যাস সমস্ত জাতির বিবেককে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। এক অতি সাধারণ “মা” রূপান্তরিত হয়ে যান অসাধারণ এক বিপ্লবী নারীতে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প গাথায় আমরা পেয়েছি এ রকম নাম না জানা অসংখ্য সাহসী মায়ের। পেলাগায়ে নিলভনা রূপান্তরিত হয়ে যান বৈপ্লবিক মাতৃত্বের এক অনির্বান প্রেরণার উৎসে। এখানে গোর্কিও হয়ে উঠেন কালোত্তীর্ণ এক উপন্যাসের অমর স্রষ্টা। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিদগ্ধ কবি ও লেখক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত “মা” উপন্যাসে “সুষমার পীড়াদায়ক অভাব” এর কথা বলেও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, ‘…..কিন্তু তাঁর ছোটগল্প ও জীবনস্মৃতি বৈচিত্র্যের বাহুল্যে তথা অপরিচয়ের বিস্ময়ে আমাদেরও মন মজায়। “দি বার্থ অফ এ ম্যান”, “ইন দি অটম”, “টোয়েন্টি সিক্‌স মেন এন্ড এ গার্ল” এবং “দি লোয়ার ডেপ্‌থস্‌” পড়লে আর সন্দেহ থাকে না যে, গোর্কি রুশ সাহিত্যের মহাপথে চলুন বা না চলুন, তাঁর রূপ নৈপুণ্য অন্য কারও চেয়ে কম নয়….”। গোর্কির সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে গোর্কির আদর্শ বিরোধী বাংলা সাহিত্যে ধীমান ও নিছক একজন সজ্জন কলাকৈবল্যবাদী কবি ও লেখকের মন্তব্যই আমাদের কাছে গোর্কির সাহিত্য কর্মের মূল্যায়নের মূল্যবান এক উৎস।

বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশক ছিল পৃথিবীর সাম্প্রতিক ইতিহাসে এক কঠিন ও যুগান্তকারী সময়। পুুঁজিবাদী বিশ্বের বিধ্বংসী মহামন্দার পটভূমিতে সফলভাবে প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে যখন সোভিয়েত রাশিয়া সুস্থির হয়ে উঠছিল সে সময়ে ১৯৩৩ সালে প্রতিবেশী জার্মানীতে হিটলারের ফ্যাসিবাদী অভ্যুত্থান রাশিয়ার অগ্রগতির পক্ষে প্রচণ্ড বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পুঁজিবাদ তথা ফ্যাসিবাদ রাশিয়ার এ নতুন সভ্যতা ধ্বংসের জন্য যে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের চক্রান্ত করছে তা গোর্কি সঠিকভাবেই তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়েই বুঝতে পেরেছিলেন। মৃত্যুর পূর্বমূহূর্তে তাই এ মহান লেখক স্বদেশবাসীকে ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ডাক দিয়ে জীবনের শেষ বিপ্লবী কর্তব্য সম্পাদন করেন এই বলে যে, “যুদ্ধ আসছে …….. তোমরা তৈরি থেকো।” এ বছর রাশিয়া ও বিশ্বের নানা প্রান্তে সাড়ম্বরে উদ্‌যাপিত হচ্ছে এ মহান শিল্পীর সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। আমরাও তাঁর জীবন ও কর্মের প্রতি জানাচ্ছি গভীর শ্রদ্ধা।  (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ