আজকের শিরোনাম :

শিলং ভ্রমণ ও রবীন্দ্রভবন দর্শন

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯ মে ২০১৮, ১৪:৪৪

তপন চক্রবর্তী, ১৯ মে, এবিনিউজ : শিলং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। ইউরোপীয় শাসকেরা একে প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলতেন। পাশ্চাত্যের স্কটল্যান্ড দেখার সুযোগ আমার হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, ‘ঘর হতে দু’পা ফেলিয়া, দেখা হয় নাই চক্ষুু মেলিয়া’’। শিলং ভ্রমণের আর একটি বড় কারণ, শিলং–এ বিশ্বকবির বাসভবন চাক্ষুষ করা। যে ভবনে বসে কবি তাঁর অমর উপন্যাস ‘ শেষের কবিতা’ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ‘রক্তকরবী’ লিখেছিলেন।

কৌতূহল ছিল, রবীন্দ্রনাথ কেনো বার বার শিলং যেতেন। তিনি ১৯১৯, ১৯২৩ ও ১৯২৭ সালে শিলং গিয়েছিলেন। তখন কলকাতা থেকে শিলং পর্যন্ত কোনো বড় সড়ক ছিল না। সড়ক যে টুকু ছিল তা দিয়ে উন্নতমানের কোনো যন্ত্রযান চলতো না। ভারতীয় রেলওয়ে সেই সময়ে আসামের বর্তমান রাজধানী গৌহাটি পর্যন্ত রেল লাইনেরও সম্প্রসারণ ঘটায়নি। কবি সম্ভবত ব্রহ্মপুত্র নদ বেয়ে স্টীমারে গৌহাটি যেতেন। গৌহাটি থেকে দুর্গম পথে একশ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে শিলং যেতেন। অষ্টাদশ শতকে গরুর গাড়ি, পরে ঘোড়ার গাড়ি এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে অ্যালবিয়ন নামের যন্ত্রচালিত গাড়ি গৌহাটি থেকে শিলং যেতো।

নানা কারণে আমার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় কয়জন তরুণ তুর্কী শ্যামলী পরিবহনের ব্যবস্থাপনায় শিলং যাচ্ছে শুনে আমিও যাওয়ার আকাঙক্ষা প্রকাশ করি। তাঁরা আমার বয়স ও দুর্বল স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেও সম্মত হন। শ্যমলী পরিবহন পাসপোর্টে মেঘালয়ের ডওকি সীমান্তের ভিসার ব্যবস্থা করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের পরিবহনে আমাদের ঠাঁই হয়নি।

আমরা আলাদা ব্যবস্থাপনায় তামাবিল হয়ে ডওকি পৌঁছি। সিলেট পর্যন্ত রাস্তা বোধ করি খুব খারাপ ছিল না। থাকলেও রাতে ঘুমঘোরে টের পাইনি। কিন্তু সিলেট থেকে তামাবিল যাওয়ার রাস্তা এতো জঘন্য যে তা বর্ণনাতীত। এমনিতে বাংলদেশের শতকরা প্রায় আশি ভাগ রাস্তা খারাপ। উন্নতমানের পাজারো জিপেও মনে হচ্ছিল দেহের হাড়গুলো আস্ত নিয়ে বোধ করি শিলং যাওয়া হবে না। সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রীর বাচনভঙ্গি উপভোগ্য, কথাও সুন্দর। তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করে উঠতে পারেন না। ঈদ–পূজা পর্ব বাদ দিলাম। তখন তো ‘হরিবোল’ (ঔমররধঠফণ) অবস্থা। অন্যান্য সময়েও দেশের যানবাহনের উপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। গলিগুঁজি বাদ দিয়ে অন্তত সড়কগুলো মসৃণ ও সুন্দর থাকলে তাঁকে পাস মার্ক দেওয়া যেতো।

বাংলাদেশে প্রায় সপ্তাহখানেকের ছুটি থাকায় প্রায় চার/পাঁচ শতাধিক ভ্রমণ পিয়াসী সীমান্তে জড়ো হয়েছিলেন। সেদিন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছিল। তামাবিল বা ডওকিতে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া প্রায় সকল সীমান্তে বহির্গমন ও শুল্ক বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের ‘বায়না’ মেটানো ছাড়া পাসপোর্ট বের করে আনা যে দুঃসাধ্য তা ভুক্তভোগী সবাই জানেন। কাজেই ঝাড়া দুই ঘণ্টারও বেশি বৃষ্টিতে ভিজে তামাবিল পার হয়ে ডওকিতে আসি। সেখানকার অব্যবস্থা আরো ভীতিকর। মাত্র দুজন কর্তা তাল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। মনে হলো ওঁরা এই কাজে নূতন ও অনভিজ্ঞ। তবে, ভাগ্যিস, ওঁরা ‘ফেল কড়ি মাখো তেলে’ রপ্ত হয়ে ওঠেননি। আরো সৌভাগ্য, তখন বরুণ দেবতা সদয় হয়ে বর্ষণ বন্ধ করেছিলেন।

বাহুল্য বলা যে, বিমান বন্দর ছাড়া অন্য সকল সীমান্তে সরাসরি বা নানা ছুতানাতায় পকেট কাটতে বাংলাদেশ ও ভারতীয় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস হাতপাকা করে ফেলেছে। অধিকাংশ যাত্রী তো সীমান্তে অনুসৃত আইন জানেন না। তাঁরা না জানার এই সুযোগটাই নেন। ভারত ও বাংলাদেশ সরকার মুদির দোকানে দ্রব্যের দাম টাঙানোর ব্যবস্থা করেছেন। দ্রব্যের গায়ে মূল্য উল্লেখের আইন আছে। কিন্তু সীমান্তে বিধিসমূহ বড় করে লিখে টানানোর ব্যবস্থা নেই। এই বিষয়ে দুই দেশের সরকারের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার জিজ্ঞাস্য, সীমান্তে কি আমাদের গোয়েন্দা নেই? ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস–এ অনৈতিক কারবার কি তাঁরা দেখতে পান না? নাকি সর্ষের মধ্যে ভূত!

দ্বিতীয়ত, বেনাপোল বা ঢাকা বিমান বন্দরে শুল্ক বিভাগে পাসপোর্ট দেখাতে হয় বটে, এর কোন রেকর্ড রাখার বা যাত্রীর স্বাক্ষর নিয়ে পাসপোর্ট ছাড়ার কোনো নিয়ম নেই। এই ব্যাপারটি ভারতের ডওকি সীমান্তেও লক্ষ্য করি। এক দেশে দুই সীমান্তে দুই নিয়ম থাকার কারণ বোধগম্য নয়।

বাংলাদেশের লোকেরা এখনো সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়ানোর অভ্যাস রপ্ত করেনি। সেই মানসিকতাও গড়ে ওঠেনি। ফলে কাকে ল্যাঙ মেরে কার আগে পাসপোর্ট বের করতে পারে তার জন্য দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যায়। এতে অফিসারেরাও দিশা হারিয়ে ফেলেন। পাসপোর্টের সিরিয়াল ঠিক রাখা তাঁদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে আমাদের পাসপোর্ট উদ্ধার হতে বিকেল প্রায় পাঁচটা।

গোদের উপর বিষফোঁড়, ডওকি থেকে শিলং যাওয়ার কার ভাড়া যেখানে দুই থেকে আড়াই হাজার রুপী, সেখানে সুযোগের অসৎ ব্যবহার করে ভাড়া ৬–৭ হাজারে দাঁড়ায়। যাঁরা এখানখার ব্যাপার–স্যাপার জানেন, বা ভ্রমণে অভ্যস্ত, তাঁরা আগেই গাড়ি ও শিলংয়ে হোটেল বুক করে রওনা দিয়েছিলেন। আমরা আনাড়ির দলে। আমাদের কোনোটিই করা ছিল না। তদুপরি শেষ বেলায় কেউ যেতেও রাজি হচ্ছিলেন না। পাহাড়ি ১০০ কিলোমিটারের পথ। রাতের অন্ধকারে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।

আমরা প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ডওকি বাজারে গিয়ে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে স্থির করে এক ট্যাক্সিওয়ালাকে দ্বিগুণ ভাড়ায় ডওকি পৌঁছাতে রাজি করাই এবং মালসমেত উঠে পড়ি। ডওকিতে নেমে হোটেল বা গেস্ট হাউজের খোঁজ করি। সেখানেও ঠাঁই নেই। শেষাবধি এক হোটেলের গর্ভগৃহে ঠাঁই মিলে চার জনের। অন্যজন মাদুর বিছিয়ে ফ্লোরে। ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের তিন গুণ। তবু ভালো রাতটা রাস্তায় কাটাতে হবে না!

এরপর অপর এক বড় সমস্যা। এখানে কোনো মানি চেঞ্জার নেই। তামাবিলেও ছিল না। বাংলা টাকা তো এঁরা নেবেন না। খাব কি? হোটেলের ভাড়া মেটাবো কী করে? যা হোক, খবর পাওয়া গেল এক মহিলা বাংলা টাকার বদলে রুপী দেন। তাঁর দ্বারস্থ হলে তিনি যে দরে দিলেন তা প্রচলিত দরের চেয়ে অনেক কম। অবশ্য পরে খোদ শিলংয়ে সরকার অনুমোদিত মানি চেঞ্জার মহিলার চেয়েও কম দেন। যা হোক, এখনকার মতো মুশকিল–আসান তো হলো।

ডওকিতে একটিই বাঙালি হোটেল। দাস হোটেল। একটা হোটেল হলে যা হয়! যা দাম হাঁকবে তাই দিতে হবে! রান্নাটা ভালো হলে তবু পুষিয়ে যেতো। রান্না ভালো করার তো ওদের কোনো দায় নেই! যা রাঁধবে তাই গিলতে হবে। পকেটের দিকে না তাকিয়ে নাক–মুখে দুটো গুঁজে ক্লান্ত দেহখানিকে বিছানায় সঁপে দেই। আমার তো জীর্ণ তরী। অশ্বমেধের ঘোড়া ডাক্তার গৌতম, অধ্যাপক সুব্রত, শেখর কবরেজ ও সমাজসেবী গণেশ কাকু– জ্যেঠুরা যেনো আমার চেয়েও ক্লান্ত বিধ্বস্ত।

পরদিন সকালে চেরাপুঞ্জি হয়ে শিলং শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। ডওকি সেতু পার হয়ে চেরাপুঞ্জির পথে যাত্রা শুরুতে গত দিন ও রাতের সকল ধকল, কষ্ট ও বিড়ম্বনা এক মুহূর্তে উবে যায়। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে পাহাড়ের পরে পাহাড়, তাতে জমে থাকা মেঘের পরে মেঘ, আর শ্যামলী নিসর্গের অফুরন্ত ভাণ্ডার। প্রকৃতির এই অপার অকৃত্রিম দান গ্রহণের জন্য যে মানসিক প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক তা সবার থাকে না। আমারও ছিল না। হঠাৎ যক্ষের ধন পেলে সাধারণ মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে, আমার অবস্থার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাই। আমি মুগ্ধ চোখে পাতা না ফেলে কেবল চেয়েই থাকি। অবিরাম একই দৃশ্যে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানকার দৃশ্য মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টে যায়। নিসর্গের প্রেক্ষাপটে অদৃশ্য কুশীলবেরা যেনো নীরবে নব নব সাজে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে চলে।

শিলং–কন্যা প্রখ্যাত সমাজকর্মী ও কবি অঞ্জলি লাহিড়ীর ‘অনন্ত যাত্রী আমি’ কাব্যগ্রন্থের ‘মেঘালয়’ কবিতায় মেঘালয়ের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে:

মেঘালয়ের আকাশ জুড়ে

নীলাম্বরী মেঘ

কোথা থেকে পায় সে ছাড়া সে

কোথায় ছুটে যায়

কেউ কি জানে ঠিকানা তার

কেউ কি জানে হায়!

হঠাৎ নামে বৃষ্টিধারা

আকাশ ভেঙে পড়ে

তুলোর মতো নীল কুয়াশা

সৃষ্টি আঁধার করে।

পাহাড় থেকে ঝনর্ণা নামে

শব্দে উতরোল

তরতরিয়ে পথ কেটে যায়

তরঙ্গ হিল্লোল।…

চেরাপুঞ্জির প্রায় শীর্ষদেশের এক পাহাড় থেকে জলপ্রপাতটি দেখা যায়। শুখা মৌসুমে পাহাড় থেকে সিঁড়ি বেয়ে অনেক নিচে নেমে জলপ্রপাতের কাছেও যাওয়া যায়। শীর্ষদেশে বেশ কয়টি দোকান ও রেস্তোরাঁ রয়েছে। এখানে আস্ত দারুচিনি গাছের ডাল ও কাণ্ড কিনতে পাওয়া যায়। চেরাপুঞ্জির ঐতিহাসিক নাম সোহরা। রাস্তার মাইল স্টোনে এখনো সেই নাম ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি পূর্ব খাসি জেলার এক শহর।

চেরাপুঞ্জির তাপমাত্রা ১১.৫–২০.৬ সেলসিয়াস। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয় বলে চেরাপুঞ্জি পৃথিবী বিখ্যাত। বছরে গড়ে প্রায় ৯৩০০ সেন্টিমিটার বা ৩৭০ ইঞ্চি বৃৃষ্টিপাত হয়। গিনেস বুকের রেকর্ডে আগস্ট ১৮৬০–জুলাই ১৮৬১ সালে এখানে ২৬,৪৭১ সেন্টিমিটার বা ১০৪২.২ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। চেরাপুঞ্জি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৪৮৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এর সেভেন সিস্টার বা সাত বোন জলপ্রপাতও পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

তবে বর্ষাকালে এর পাহাড়ের দৃশ্যপট বদলে যায়। সহস্র ধারায় জল নামতে থাকে। এই জল থেকেই সৃষ্টি হয়েছে মেঘালয়ের উমইয়াম ও উমঙ্গট নামের দুটি প্রধান নদী।

বর্ষায় চেরাপুঞ্জি পাহাড়

অবশ্য ঘোর বর্ষায় পাহাড়ের গা বেয়ে অজস্র ঝর্ণা নামে। পর্যটকেরা সাধারণত বর্ষায় চেরাপুঞ্জি যায় না। চেরাপুঞ্জির সসিনর‌্যাম গ্রামেই সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি পড়ে।

আমরা মে মাসের প্রথম সপ্তাহে গিয়েছিলাম। তখন প্রখর রৌদ্রতাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। চেরাপুঞ্জিতে এই সময়টায় কালেভদ্রে বৃষ্টি হয়। তবে বৃষ্টি যে কোনো সময় হুট করে নেমে আসতে পারে। এই অভিজ্ঞতা হয়েছে পরে। চেরাপুঞ্জির শীর্ষ থেকে নেমে আসার পথে একটি প্রকৃতিক সুড়ঙ্গ আছে। পাহাড়ে খানিকটা উৎরাই বেয়ে উঠে সুড়ঙ্গে ঢুকতে হয়। আমি ঝুঁকি নেইনি। সাথীরা গিয়েছিল। প্রায় দুই কিলোমিটারের এই সুড়ঙ্গ নাকি রোমাঞ্চকর।

শিলং পৌঁছি বিকেল প্রায় পাঁচটায়। আমাদের গাড়ি পার্ক করা হয় শহরের কেন্দ্রে পুলিশ বাজারে। সুব্রত, শেখর, গণেশ হোটেল ও মানি চেঞ্জারের তালাশে বেরিয়ে পড়ে। আমি আর গৌতম গাড়িতে। গাড়ি থেকে বাঁয়ে ব্রাহ্ম হোমের একটি গেস্ট হাউস দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিলো যে হোটেল পাওয়া মুশকিল হবে। কারণ শহরময় পর্যটকে সয়লাব। হলোও তাই। ওরা পঞ্চাশটি হোটেল দেখে হতাশ হয়ে এসে দুঃসংবাদ জানায়। আমি চট করে নেমে লাঠি হাতে ব্রাহ্ম গেস্ট হাউসে গিয়ে রিসেপশনের মহিলাকে রুম বরাদ্দের আবেদন জানালে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। আমি তাঁর হাতে আমার ভিজিটিং কার্ড দেই। তিনি এক পলক নজর বুলিয়ে তা সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে পাঠান। মিনিটের মধ্যে দীর্ঘদেহী, সুশ্রী, প্রবীণ ও সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোক এসে আমার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন এবং আমায় অভয় দেন।

ভদ্রলোকের নাম শ্রীসুরজিত দত্ত। তিনি আমরা কয়জন জানতে চান। পাঁচজন শুনে তাঁকে চিন্তিত দেখালো। বললেন মহিলা আছেন কি না। নেই শুনে তিনি স্বস্তিবোধ করেন। তিনি ডরমিটরিতে খাটিয়া ঢোকানোর ব্যবস্থা করে বলেন যে, একজনকে ফ্লোরে মাদুরের উপর রাত কাটাতে হবে। কাল ওনার ব্যবস্থাও হবে। গাড়ি থেকে ব্যাগ নামিয়ে এনে ডরমিটরিতে রাখা হলো। চার সিটের ডরমিটরিতে আট জনের ব্যবস্থা হলো। তিন সিটে বাংলাদেশের তিন মুসলিম যুবক ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন সিলেট জালালাবাদ কলেজের নবীন অধ্যাপক।

ব্যাগ নিয়ে অন্যেরা ডরমিটরিতে গেলে আমি সুরজিত বাবুকে বলি যে, আমি কেবল প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড দেখতে আসিনি। রবীন্দ্রনাথের বাসভবন দেখার খুব ইচ্ছা, যে ভবনে বসে তিনি তাঁর অমর সৃষ্টি রচনা করেছেন। তিনি আমাকে রিলবং যাবার পরামর্শ দেন।

চেরাপুঞ্জির পাহাড়ি সড়ক মসৃণ ও ছিমছাম দেখেছি। চেরাপুঞ্জি পেরিয়ে শিলং শহরে ঢুকি। শিলং–এর রাস্তা যেনো আয়নার মতো স্বচ্ছ, ঝকঝকে পরিষ্কার। রাস্তায় এক টুকরো কাগজ, পলিথিন ব্যাগ নেই। মাঝে মাঝে শহরে থুথু ফেলারও নিষেধাজ্ঞা চোখে পড়ছে। সবচেয়ে বড় বিস্ময় রাস্তায় শ’য়ে শ‘য়ে কার ছুটেছে। কেউ হর্ন বাজাচ্ছেন না। কেউ কাকেও ওভারটেক বা আন্ডারটেক করছেন না। অ্যাম্বুলেন্স যেতে কর্ণভেদী বিকট আওয়াজ নেই। লাল পতাকা দেখে সবাই সরে গিয়ে এর পথ করে দিচ্ছেন। পুলিশের জলপাই রঙের পতাকা দেখেও একই আচরণ।

সন্ধ্যায় নৈশভোজের জন্য শহরে বেরোই। লোকজন ট্রাফিক পুলিশের অনুমতি ছাড়া রাস্তা পার হচ্ছেন না। মানুষ উচ্চঃস্বরে কথাও বলছেন না। মনে হচ্ছে কেউ প্রকৃতির নৈঃশব্দ ভাঙতে রাজী নন। শহর জুড়ে পরিকল্পিতভাবে পাইন, দেবদারু ও অন্যান্য গাছের সারি। শিলং শহরে স্থানীয় মানুষ থেকে পর্যটকের সংখ্যাই বেশি মনে হলো। ভেজ, ননভেজ, বাঙালি, পাঞ্জাবি, দক্ষিণ ভারত ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মানুষের রসনা তৃপ্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

মেঘালয় উত্তর–পূর্ব ভারতের ছোট এক পাহাড়ি রাজ্য। খাসিয়া, জয়ন্তিকা ও গাড়ো পাহাড় নিয়ে এই রাজ্য গড়া হয়েছে। এর রাজধানী শিলং পূর্ব খাসি জেলার পাহাড়ে অবস্থিত। এটি সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৪৯৬ মিটার উঁচুতে এবং এর উচ্চতম শৃঙ্গের নাম শিলং পিক। এর উচ্চতা ১৯৯৬ মিটার। ২০১১ সালের জনসংখ্যা গণনা অনুযায়ী এর লোক সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ । ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৪ সালে এই শহরের পত্তন ঘটায়। তখন শিলং অবিভক্ত আসামের রাজধানী ছিল। ১৭৭২ সালের ২১ জানুয়ারি মেঘালয়ের জন্ম। এই সময় থেকে গৌহাটি আসামের রাজধানীর মর্যাদা পায়।

শিলং–এও বেশ বৃষ্টিপাত হয় তবে চেরাপুঞ্জির তুলনায় অনেক কম। আপমাত্রা ঊর্ধ্বে প্রায় ২৪ ডিগ্রি ও নিচে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৮৯৭ সালে এখানে রিখটার স্কেলের ৮.১ মাত্রায় ভূমিকম্প হয়। ফলে এতদঞ্চলের ভূমিরূপ পরিবর্তিত হয়। মেঘালয়ে শতকরা ৮৫ ভাগ খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী। এখানে খাসি জনসংখ্যা বেশি। তারপর জয়ন্তিয়া ও গারো জনসংখ্যা। ভাষা মূলত খাসি ও ইংরেজি। শিক্ষিতের হার শতকরা ৯৫ এর উপরে। শতকরা ৯১ মহিলা শিক্ষিত। শিলং শহরে খ্রিষ্টান ৪৬%, হিন্দু ৪২%, মুসলিম ৫% এবং বাদবাকি বৌদ্ধ জৈন সব মিলিয়ে। অধিকাংশই উচ্চশিক্ষিত। এখানে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ভ্রমণ করতে পারলে ভালো। এখানকার কমলা খুব সুস্বাদু। এটিই চেরাপুঞ্জির প্রধান রপ্তানিযোগ্য ফসল।

২০১৮ সালের মে মাসের ৩ তারিখ বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারটার বাসে আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। শুক্রবার রাত ডওকিতে কাটিয়ে শনিবার সকালে চেরাপুঞ্জি। বিকেলে শিলং। পরদিন অর্থাৎ রবিবার ভোর ছয়টায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহাসিক কামাখ্যা–কামরূপ মন্দির দর্শনের উদ্দেশে রওনা দেই। ভোরের আগে সাফাই কর্মীরা রাস্তা পরিষ্কার করে রেখেছেন। শিলং থেকে গৌহাটির ১০০ কিলোমিটার পথ চড়াই–উৎরাই, পাহাড়ের অসংখ্য বাঁক পেরিয়ে যেতে হয়। তাতেও সময় লাগে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। বুঝতেই পারছেন রাস্তা কতো ভালো হলে এতো কম সময়ে এই দূরত্ব অতিক্রম করা যায়।

কামাখ্যা মন্দির নীলাচল পাহাড়ের উপর অবস্থিত। আট থেকে সতের শতকের মধ্যে এই পাহাড় ও মন্দিরের নানা পরিবর্তন সাধিত হয়। আমরা পথে নাস্তা করতে গিয়ে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় ব্যয় করি। তবুও বেলা নয়টার মধ্যে পৌঁছে যাই। পাহাড়ের চূড়ার পৌঁছার প্রায় আধ কিলোমিটার আগে অপর এক গাড়ি চালকের পরামর্শে গাড়ি রাস্তার পাশে পার্ক করে আমরা পদব্রজে উৎরাই ভেঙ্গে চলতে থাকি। অবাক হয়ে তাকাই অসংখ্য গাড়ি ও দর্শনার্থী। উপরে গাড়ি পার্কিং লটে প্রায় পাঁচ শতাধিক গাড়িতে ভর্তি।

রাস্তার একপাশে পূজার ডালি বিক্রির দোকান। সব দোকানে কমন ফুল জবা ও ফল নারিকেল। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকে বাড়ির ভিত প্রদান বা নূতন গাড়ি চালু করার আগে নারকেল ভাঙ্গে। নারকেল সুস্বাদু ফল সন্দেহ নেই। কিন্তু এর সঙ্গে শুভাশুভের কি সম্পর্ক তা আমার জানা নেই। যতোই এগোই ততোই দর্শনার্থীর ভিড়। সঙ্গে ছাগ–শাবকের আর্তনাদ। অনেকে প্রায় মুমূর্ষু দুই আড়াই কেজি ওজনের ছাগ–শিশু (পাঁঠা) কামাখ্যা মাকে নিবেদনের জন্য ডাক–ঢোল, কাঁশর বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে চলেছে।

রাস্তার পাশে কিছু দূরে দূরে হরেক রকম সাজে সাধু সন্ন্যাসীর নানা ধরনের কসরৎ দেখানো চলছে। কথিত আছে, এখানকার সাধুরা নাকি মন্ত্রসিদ্ধ। এঁরা নানা তুকতাক, বশীকরণ, ‘বাণমারা’ ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত। দক্ষিণার বিনিময়ে এরা মানুষকে তা শেখায়। শেখর তার বৌকে ফোনে বলছিলো, “বেশি মেজাজ দেখিয়ো না, কামরূপ–কামাখ্যা যাচ্ছি। তুক–তাক শিখে এসে সব মেয়ে মানুষকে বশে নিয়ে আসবো। তখন টের পাবে কত ধানে কত চাল।”

কিছুদূর উঠার পর লেখা রয়েছে ‘এখানে জুতা ও সেন্ডেল’ রাখা হয়। জুতা রাখার জন্য বেশ কটি দোকান। দর্শনীর বিনিময়ে জুতা রাখতে হয়। এর পর খালি পায়ে হাঁটা। শীর্ষে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া । বিশাল লাইন। মায়ের বেদীর কাছে পৌঁছাতে অন্তত তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। অতক্ষণ দাঁড়ানো সম্ভব নয় ভেবে আমি, গৌতম ও সুব্রত বসে পড়ি। গণেশ ও শেখর লাইনে দাঁড়ায়। এরা ইমিগ্রেশন কাস্টমস–এ যেমন করে ‘ম্যানেজ’ করে এখানেও দু’নম্বর পথে ‘ম্যানেজ’ করে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফুল নারিকেল হাতে এসে হাজির। ততক্ষণে আমরা গাড়িতে চলে গিয়েছিলাম।

গৌহাটিতে অনেক দর্শনীয় জায়গা আছে। কিন্তু আমাদের সময় নেই। গৌহাটি থেকে শিলং যাওয়ার পথে গৌহাটিতেই মাড়োয়ারিদের গড়া খুব সুন্দর, পরিচ্ছন্ন বড় ছোট মিলিয়ে তিনটি মন্দির পরিক্রমা করি। এইগুলো বালাজি মন্দির নামে খ্যাত। মন্দিরের বিশাল প্রাঙ্গণ, শ্যামলী নিসর্গ ও শৃঙ্খলা সব মিলিয়ে সকল ধর্মের মানুষের জন্য বিনোদনের এক অনবদ্য আয়োজন। এর ঘিয়ে পাকানো খিচুরির স্বাদ ভুলবার নয়। তারপর কিছু দূরে দুপুরে এক পাঞ্জাবি ধাবায় খাওয়া সেরে উমিয়াম লেকে আসি।

উমিয়াম লেক স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন লেকসমূহের মধ্যে অন্যতম। এটি পাহাড় ঘেরা। বিস্তার কয়েক কিলোমিটার। এত নৌকাবিহারের ব্যবস্থা আছে। পর্যটকরা মনে রাখবেন যে, এখানে রবিবারে সব বন্ধ থাকে। দর্শনীর বিনিময়ে দ্রষ্টব্য স্থানগুলোও। যে কারণে আমরা অনেক দর্শনীয় স্থানে গিয়ে ফিরে এসেছি। শিলংয়ে দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো এলিফ্যান্ট ফল, শিলং পিক, লেডি হায়দারি পার্ক, ওয়ার্ডস লেক, ক্যাপ্টেন উইলিয়ামসন সংমা স্টেট মিউজিয়াম, ডন বস্কো উপজাতীয় মিউজিয়াম, কীট–পতঙ্গের মিউজিয়াম, ক্রাইসেলিস গ্যালারি, ক্যাথেড্রাল অফ মেরী হেল্প অব ক্রিষ্টিয়ানস, সুইট ফলস ও অন্যান্য। সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো মওলিনঙ (ুটষফধভভমথ) গ্রাম। এই গ্রাম শিলং থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে, ডওকি যাওয়ার পথে। এই গ্রাম এশিয়ার মধ্যে পরিচ্ছন্নতম গ্রাম হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।

উমিয়াম লেক থেকে গল্ফ কোর্স হয়ে আমরা ক্যাথেড্রালে পৌঁছি। গল্ফ কোর্স বসা ও বেড়ানোর সুন্দর জায়গা। এর বিশেষত্ব হলো পাহাড়ের উপরে প্রাকৃতিকভাবে উঁচু নিচু হয়ে কৃত্রিম গল্ফকোর্সের মতো গড়ে ওঠা। এটি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দর গল্ফকোর্সসমূহের মধ্যে একটি।

এটি বিশাল জায়গা জুড়ে অবস্থিত। প্রাঙ্গণ ও ঘরগুলো ছবির মতো সাজানো ও ছিমছাম। এখানে ক্রশের সামনে ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন স্বর্গীয় সুষমামণ্ডিত এক নারী। রয়েছে মা মেরীর অপূর্ব সুন্দর ভাস্কর্য। প্রার্থনা গৃহ, শিক্ষার্থীর হোস্টেল, স্কুল সব মিলিয়ে এক নান্দনিক পরিবেশ। রয়েছে নিখুঁত পরিকল্পনা ও রুচিবোধের ছাপ। শিলং–এ প্রথম দিকে আসা মূলার সাহেবের কালো পাথরের ভাস্কর্য মূর্তি রয়েছে। মূলার সাহেবের উক্তি খোদিত আছে। তিনি বলেছিলেন “ যদি খাসিয়াদের এক করতে না পারি তাহলে আমাদের এখানে আসা বৃথা।”

সন্ধ্যার ঠিক আগে ব্রাহ্ম গেস্ট হাউজে ফিরে আসি। আমি আর সুব্রত গেস্ট হাইজের রিসেপশনে বসি। অন্যরা শহরে কেনাকাটার জন্য চলে যায়। আমি সুরজিৎ বাবুর খোঁজ নেই। রিসেপশন জানায় যে আধ ঘণ্টার মধ্যে এসে যাবেন। মিনিট পনেরর মধ্যে তিনি আসেন। তাঁকে জানাই যে গাড়ির ড্রাইভার সহ পথচারীদের জিজ্ঞেস করে ঠাকুরের বাসভবনের হদিশ করতে পারিনি। তিনি বলেন, গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন? আমার হাঁ বাচক শব্দ শুনে আমাকে বলেন চলুন। তিনি পুলিশ বাজার থেকে রিলবং আসা যাওয়ার জন্য দুশ টাকা ভাড়ায় এক ট্যাক্সী নিয়ে আমি ও সুব্রতকে নিয়ে রিলবং পৌঁছান।

রবীন্দ্রনাথ দুই বাড়িতে আতিথ্য নিতেন। একটি ব্রকসাইটে ও অপরটি কিঞ্চিৎ দূরে জিৎ ভূমিতে। মেঘালয় সরকার আন্দোলনের মুখে ব্রুকসাইডের বাড়ি দখল করে রবীন্দ্র মেমোরিয়েল বনাম মিউজিয়াম তৈরি করতে বাধ্য হন। এই বাড়ির মালিক বাড়ি ভেঙে কাঠামো পরিবর্তনে উদ্যোগী হলে শিলংয়ের বিখ্যাত কবি ঊমা পুরকায়স্থ ও সেন্ট এডমন্ট কলেজের অধ্যক্ষ সিলভ্যানাস ল্যামারের নেতৃত্বে ঠাকুরের বাসভবন সরকারের এক্তেয়ারে আনার জন্য আন্দেলন শুরু হয়। এর সঙ্গে খাসি কবি হেমলন ডিয়েংডোও খাসিদের নিয়ে আন্দোলনে ইন্ধন যোগান। হেমলন রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ সহ অনেক রচনা অনুবাদ করেন। টেগোর’স মেমোরিয়েল প্রতিষ্ঠা তাঁদেরই আন্দোলনের ফসল। মিউজিয়াম রোববারে বন্ধ থাকে। কাচের ভিতর দিয়ে দেখারও উপায় নেই। কারণ পর্দাঘেরা। সাধাসিধে আটপৌরে বাড়ি। সামনে পেছনে বিস্তীর্ণ প্রান্তর। পাশে বেয়ে চলেছে ক্ষীণ স্র্রোতস্বিনী। সামনের প্রাঙ্গণে কবির ভাস্কর্য যেনো আমাদেরকে আহ্বানের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। পেছনের প্রাঙ্গণে মৌন শতবর্ষী তিনটি বড় ইউক্যালিপটাস বৃক্ষ আজো কবির স্মৃতি মেখে দাঁড়িয়ে আছে।

অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে দেখে সুরজিত বাবু বলেন, চলুন জিৎভূমি দেখতে যাই। ঠাকুর যেখানে বসে ‘রক্তকরবী’ লিখেছিলেন। সেই বাড়ির উত্থুঙ্গ তোরণের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। বিশাল লোহার গেট হাতি বাঁধার শিকলে বিশাল তালাবদ্ধ। এখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। বাড়িটি জনৈক চক্রবর্তী কিনে নিয়েছেন। বাড়ির সামনের বিস্তীর্ণ পা্রন্তর উন্মুক্ত। প্রান্তর ঘিরে ঘন পাইন ও দেরদারু গাছের নিবিড় সখ্য। তোরণের ডান পাশে শ্বেত পাথরে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা রয়েছে যে এই বাড়িতে বসে কবি ‘রক্ত করবী’ সৃজন করেছিলেন। জানা গেলো স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীরা এখনো এই জিৎভূমি অধিগ্রহণ করার জন্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন। তবে তাঁদের অভিযোগ এই বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। এর জন্য ক্ষোভও পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সুরজিত বলেন, আপনারাও লিখুন না। গবেষকরা এখানে বিশ্বকবি সম্পর্কে আরো অনেক নূতন তথ্য পেতে পারেন।

গেস্ট হাইজে ফিরে সুরজিৎ বাবু আমাকে চা–পানে আপ্যায়িত করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি জানান যে তাঁর বোন শিলং শহরের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। বোনের নাম সুবর্ণ প্রভা দাস। তিনি ও তাঁর মা সারদা সুন্দরী দত্ত শিলংয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার মূল কারিগর। সুরজিতের পিতামহ হার্বার্ডের ফার্মাসিস্ট। পিতা চিকিৎসক। শিলং–এ এঁদের পরিবারের সমৃদ্ধ অবদান রয়েছে। তিনিও আমার মতো লক্ষ্মীছাড়া। এখন সমাজসেবাই তাঁর ব্রত। তাঁর সম্যক পরিচয় জানার কৌতূহল থাকলেও চেপে যাই। তিনিও এই ব্যাপারে উচ্চকিত নন। ১৮৯৪ সালে এখানে ব্রাহ্ম গেস্ট হাউজের পত্তন ঘটে। এখন তিনি দেখাশোনা করেন। এখানে সর্বসাধারণের জন্য একটি রবীন্দ্র গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছেন।

সুব্রত ডরমিটরিতে চলে যাওয়ার পর গৌতম আসে। মনে মনে আমাকে আমার সেই প্রশ্ন তাড়া করে। আমি সুরজিতকে জিজ্ঞেস করি, এই দুর্গম পথে কবি কিভাবে বার বার আসতেন! তখন তিনি কি ভেবে এক ভদ্রলোককে ফোন করেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, চলুন কাছেই এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। তিনি এই শহরের আদি লোক। তাঁর মুখ থেকে শুনবেন। গৌতম সহ আমরা হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে জানালেন হাঁটা পথের আশপাশের সকল দোকান ও সম্পত্তি আহমদ হোসেন সাহেবদের। একসময় শিলংয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভূসম্পত্তি তাঁদেই ছিল। বুঝতে পারলাম আমরা আহমদ হোসেন সাহেবের সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছি।

হাজার হাজার কোটিপতি আহমেদ হোসেনের বাসস্থান নিতান্তই একটি একতলা বাংলো বাড়ি। ঘরের আসবাবপত্রও সেকেলে। আমাদের পৌঁছার পর বেল টিপতেই ভদ্রলোক দরোজা খুলে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানান। সুরজিৎ বলেন, আহমদ হোসেন সাহেব একজন অনন্য বড় ফটোগ্রাফার। ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের প্রাণী ও উদ্ভিদ বিষয়ক তাঁর ফটো সংগ্রহশালা রয়েছে। আমাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পর্ব শেষে আহমদ হোসেন সাহেব জিজ্ঞেস করেন, আপনারা কি জানেন, এই শিলংয়ে বাংলাদেশের একান্ন জন তরুণ কবরে শুয়ে আছেন। এই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের কবর তিনি নিজ হাতে দিয়েছেন। তারপর সংক্ষেপে তিনি ও সুরজিৎ বাবুর পরমাত্মীয় সাহিত্যিক ও সমাজসেবী অঞ্জলি লাহিড়ির দীর্ঘ নয় মাসে তাঁদের পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা পালনের কাহিনি শোনান। তিনি জানান যে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি সিলেটে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন কর্নেল শওকত, মেজর জিয়া ও ন্যাপের আলতাপ হোসেন। অঞ্জলি লাহিড়ি বাংলাদেশের ‘আইন ও সালিশি কেন্দ্র’ প্রকাশিত ‘স্মৃতি ও কথা ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে সিলেট–তামাবিল সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধে তাঁদের ভূমিকা সবিস্তার বলে গেছেন। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে সমৃদ্ধ অবদানের জন্য ২০১২ সালে আহমদ হোসেন সাহেব ও অঞ্জলি লাহিড়িকে সম্মাননা প্রদান করায় তাঁরা গর্বিত বোধ করেছেন বলে জানান।

আহমদ হোসেন সাহেব রবীন্দ্রনাথের শিলং আসার কাহিনি জানাতে গিয়ে অনুষঙ্গ হিসেবে তাঁর পরিবারের শিলংয়ে আসার কাহিনিও সংক্ষেপে বিবৃত করেন। তাঁর পূর্বপুরুষ খান বাহাদুর হাজি কাশিমউদ্দিন মোল্লা ১৮৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বেগমপুর থেকে শিলংয়ের চেরাপুঞ্জিতে এসেছিলেন। তিনি ও তাঁর ছেলে গোলাম হায়দার চেরাপুঞ্জিতে দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসায় উন্নতি হচ্ছিল। এই সময় গরুর গাড়ি গৌহাটি থেকে প্যাসেঞ্জার নিয়ে শিলং আসতো। ১৮৮৭ সালে কাশেম মোল্লা ব্রিটিশ প্রশাসনকে ঘোড়ার গাড়িতে প্যাসেঞ্জার আনা–নেওয়ার প্রস্তাব দিলে প্রশাসন দুটি শর্ত দেন। প্রথম শর্ত ৮০ টি ঘোড়া কিনতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, ১০০ কিলোমিটার পথে মোট পনেরটি আস্তাবল রাখতে হবে। কাশেম মোল্লা সেই শর্তদ্বয় পূরণ করে ঘোড়ার গাড়িতে প্যাসেঞ্জার আনা–নেওয়া শুরু করেন। তিনি ১৯০৬ সালে এই পথে অ্যালবিওন (ইফঠধমভ) নামের মোটর গাড়ি চালু করেন।

আহমদ হোসেন সাহেবের বর্তমান বয়স ৮৩ বছর। স্মরণশক্তি অসাধারণ। তাঁর ধারণা, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মপুত্র নদ বেয়ে স্টীমারে গৌহাটি আসতেন। স্টীমার ঘাট থেকে গরু বা ঘোড়ার গাড়ি করে গৌহাটিতে অ্যালবিওনের স্ট্যান্ডে আসতেন। তিনি শুনেছেন, কবি একবার কাদায় পড়ে গিয়েছিলেন তখন তাঁকে ‘থাপি’– তে (চা–বাগানের কর্মীরা পিঠে যা বহন করেন) করে গৌহাটিতে আনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ব্রুকসাইডের বাড়িতে (বর্তমান রবীন্দ্র মিউজিয়াম) বেশি সময় কাটিয়েছেন। তাঁর সেবাযত্ন করতেন আহমদ হোসেন সাহেবের পরমাত্মীয়রা। ১৯৭১ সালে শ্রীসতীশ জীবন দাস শিলংয়ের কমিশনার ছিলেন। তিনি এই বাড়িতে থাকতেন। তিনি চলে যাওয়ার সময় এই বাড়িটিকে টেগোর মেমোরিয়েল করার ব্যবস্থা করে যান।

আহমদ হোসেন সাহেব ফাঁকে ফাঁকে আরো অনেক কথা বলে যাচ্ছিলেন। এক সময় বলেন যে, শিলং থেকে সিলেট পর্যন্ত রাস্তা বানিয়েছিলেন এক ইংরেজ প্রশাসক। তিনি কন্ট্রাক্টর রাস্তা ঠিকমতো বানিয়েছেন কি না তা দেখার জন্য ড্রাইভারকে তৎকালীন সময়ে গাড়ির পেছনে রাখার ঝাঁঝড়ায় পানি ভর্তি একটি গ্লাস বসাতে বলেন। শতাধিক কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে কোথাও যদি এক ফোঁটা পানি পড়ে তাহলে বোঝা যাবে কন্ট্রাক্টর সেইখানটায় ঠিকমতো কাজ করেননি। তিনি হাসলেন। আমরাও। মনে হচ্ছিল তিনি যেনো উত্তর পূর্ব ভারতের জীবন্ত বিশ্বকোষ। আমাদের দুর্ভাগ্য, বেশিক্ষণ বসার জো ছিল না। শিলংয়ে রাত আটটার পর খাবারের দোকান বন্ধ হয়ে যায়। আমরা তাঁকে ও মহান পরোপকারী সুরজিৎ বাবুকে বাংলাদেশে আসার অনুরোধ জানিয়ে বিদায় নেই। সুরজিত বাবু বললেন, আপনাদের কাল সকালে ৭টায় বেরোনোর আগে আমি বাড়ি থেকে অঞ্জলি লাহিড়ির দুটো বই পাঠিয়ে দেবো। দিয়েছিলেনও। তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ পাইনি। এখানে এসে ই–মেইল করেছি। জবাব পাইনি।

ড্রাইভারের সঙ্গে কথা ছিল সকালে দ্রষ্টব্য স্থান দেখে দেখে ডওকি চলে যাবো। কিন্তু দেখবো কী করে! দশটার আগে কেউ কি অফিস খোলে? সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল শিলং পিক বা শৃঙ্গ দেখা। এটি এয়ারফোর্সের ঘাঁটির ভিতরে। গেইটে পাসপোর্ট, ক্যামেরা, মোবাইল জমা রেখে, বডি সার্চ সেরে ঢোকানো হয়। আমরা গেইটের কাছে গিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেখে হা–হতোস্মি হলাম। ভারতীয় ছাড়া বিদেশীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাইরে জানলাম পাসপোর্টধারী বঙ্গ সন্তানদের কেউ নিষেধ না মেনে গোপনে ছবি তোলার অপরাধে নিরাপত্তার স্বার্থে দিল্লি থেকে এই আদেশ এসেছে। আমি তোরণ পেরিয়ে ভিতরে গিয়ে অফিসারের সঙ্গে কথা বলি। তিনি বিনীতভাবে তাঁর অপারগতার কথা ব্যক্ত করেন। শৃৃঙ্গে এক প্রবীণ ভদ্রমহিলার দোকানে লুচি ও আস্ত ছোলার তরকারি দিয়ে নাস্তা সারি।এরপর এলিফ্যান্ট ফলস। কী বৃষ্টি! ছাতা আছে কেবল আমার। বাবুরা বিশ টাকা ভাড়ায় ছাতা নিয়ে জলপ্রপাত দেখতে নেমে যায়। আমি খোঁজ নিয়ে জানলাম ১৯৮ টা সিঁড়ি ভেঙে নামতে হবে। প্রতি সিঁড়ি উচ্চতায় দুই থেকে আড়াই ফুট। ভেবে দেখলাম নামতে হয়তো পারবো। উঠতে ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে। তাতে আমার কোনো ক্ষতি নেই। বিদেশ বিভূঁইয়ে সাথীরা বিপদে পড়বে। তদুপরি, ফলসে নামার মুখে এর ইতিহাসে লেখা রয়েছে, ব্রিটিশরা এলিফ্যান্ট ফলস নাম রেখেছিলেন। কারণ ফলসের পাশের ভূভাগ হাতির মতো দেখাতো। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে সেই অঞ্চল ধ্বসে যায়। তাহলে এটিও অন্য পাঁচ–দশটি ফলসের মতো হবে কল্পনা করে নিলাম। এই বয়সে দুধের সাধ ঘোলে মেটানো ছাড়া আর কি উপায় আছে!

এরপর ডওকির উদ্দেশ্যে রওনা। সিলেটে ফোন করে তামাবিলে একটার দিকে গাড়ি পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর মেঘের বাড়ি মেঘালয়ের আসল রূপ ধরা পড়লো। পাহাড়ের গায়ে গায়ে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ কোথাও হালকা কোথাও ঘন। মেঘ উপরে উঠে যাচ্ছে, ছুটোছুটি করছে, বৃষ্টি হয়ে ভারমুক্ত হচ্ছে। আমাদের গাড়ি কোনো কোনো সময় মেঘের ভিতর দিয়ে চলছে। এই দৃশ্য দেখার, বোঝাবার নয়। মিজোরামে আমার এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমার সাথীরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে অনবরত ছবি তুলেই চলেছিল। ডওকি সেতুর কাছে আসার আগে থেকে সিলেটের জাফলং দেখা যাচ্ছিল। এরপর যথারীতি সীমান্তের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ইলশে গুঁড়া বৃষ্টির মধ্যে কর্দমাক্ত রাজপথে সিলেটের দিকে রওনা দেই।

পাশ্চাত্যের স্কটল্যান্ড দেখার সুযোগ হলে লন্ডনে শেকসপীয়রের বাসভবন হয়তো দেখতে পেতাম। শিলং গিয়ে প্রাচ্যের শেকসপীয়র বিশ্বকবির অমর সৃষ্টিভূমি স্পর্শ ও চাক্ষুষ করার সৌভাগ্যও কম নয়! (সংগৃহীত)

এবিএন/ফরিদুজ্জামান/জসিম/এফডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ