আমার তোলা ছবি দেখে বঙ্গবন্ধুকে এঁকেছেন শাহাবুদ্দিন ভাই
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০:৫৪
চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। তার ক্যানভাসে ফুটে ওঠে সংগ্রামী মানুষের অভিব্যক্তি, প্রতিকৃতি। রঙ-তুলির যুগলবন্দিতে তিনি এঁকে যান স্বকীয় শৈলীতে। চিত্রকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেছে, পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা নাইট উপাধি। ক্যামেরার কবি বলে খ্যাত আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের সঙ্গে তার পরিচয় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে। ক্যামেরা হাতে তিনি ধারণ করেছেন এ শিল্পীর লড়াই, সংগ্রাম ও অর্জনের মুহূর্তগুলো। আজ ১১ সেপ্টেম্বর, শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের জন্মদিন উপলক্ষে তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন। কথোপকথনের ভিত্তিতে সেটি লিখেছেন রুহিনা ফেরদৌস
শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ ১৯৬৬ সালে, তার আগের বছর তার ছোট ভাই কফিলউদ্দিনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়। আমরা থাকতাম গ্রিন রোড স্টাফ কোয়ার্টারে, তারা থাকতেন কলাবাগানে নিজস্ব বাড়িতে। ১৯৭১ সালের আগে অনেকবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তখন আমি ছবি তোলা শুরু করিনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিয়ে শাহাবুদ্দিন ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে তিনি ও তার সহযোদ্ধারা অস্ত্রশস্ত্রসহ ঢাকায় প্রবেশ করেন। হানাদার বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে বিপর্যস্ত-পরাজিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা হানাদারমুক্ত হচ্ছে বলে খবর আসছে, সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উড়ছে। মুক্তির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে ঢাকায় আসছেন। তখন শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয় কলাবাগানে, তাদের বাড়িতে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সকালে। আর্মিদের একটা পুরনো জিপগাড়ি নিয়ে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে শাহবাগের দিকে এগোচ্ছিলেন তারা।
হঠাৎ পুলিশ কন্ট্রোল রুম থেকে গুলির আওয়াজ, আমরা পিজি হাসপাতালের সামনে ছিলাম। আমার বন্ধু শফিকের ছোট ভাই মফিক, তারা শাহাবুদ্দিন ভাইদের পরিবারের সঙ্গে যুক্ত, সে আমার পাশে ছিল, গায়ে গুলি লাগলে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পিজি হাসপাতালের গেট খোলা থাকায় আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে সেখানে চলে যাই। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন শাহাবুদ্দিন আহমেদের ভাই। এরপর আমরা সব দৌড়ে একেক দিকে চলে গেলাম। তখন বেলা আড়াইটার মতো বাজে।
এখন যেখানে বাংলাদেশ বেতার, সেখানে ছিল রেডিও পাকিস্তানের অফিস। পাশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, যেখানে উপস্থিত ছিলেন সারা বিশ্ব থেকে আসে বিভিন্ন সাংবাদিক। বেশ কিছুদিন তাদেরও অনেকটা বন্দি অবস্থায় কাটাতে হয়। ১৬ ডিসেম্বর তারাও বেরিয়ে আসছিলেন। চারদিকে তখন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। শাহাবুদ্দিন ভাই সাহস করে রেডিও ভবনের ছাদে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিলেন। সময়টা দুপুরের কিছু পরে। আমরা তখনো জানতাম না যে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, যেখানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময় শাহাবুদ্দিন ভাই দুঃসাহসটা দেখিয়েছিলেন, যা ছিল অভাবনীয়। কারণ যেকোনো জায়গা থেকে পাকিস্তান আর্মিদের গুলি তখন আসতে পারত। তারা পিজি হাসপাতালে ক্যাম্প করে ছিল, পুলিশ কন্ট্রোল রুমটা তখনো পাকিস্তানিদের দখলে। সেখানে তখনো কয়েকশ পাকিস্তানি সেনা ছিল।
শাহাবুদ্দিন ভাই যখন পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন, আমাদের তখন মনে হয়েছিল আমরা এখনই স্বাধীন হয়ে গেছি। বিজয়ের এ রোমাঞ্চকর ঘটনার সময় আমি শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম। পাকিস্তান আর্মির আত্মসমর্পণের কথা আমরা জানলাম সন্ধ্যার দিকে রেডিওতে। জায়গায় জায়গায় উল্লাস হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা উল্লাস করছেন। হাজার হাজার মানুষ ঢাকায় প্রবেশ করছে।
এসব দেখে আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে অনেক ঘটনা ঘটে যাবে, ওই রাতে আমি বিভিন্ন জনের কাছে, বিভিন্ন জায়গায় স্টুডিওতে গিয়ে ক্যামেরা ধার চেয়েছিলাম, যারা আগেও আমাকে ক্যামেরা দিয়েছে ছবি তোলার জন্য। কিন্তু সে সময় সাহস করে কেউ আমার মতো অরক্ষিত তরুণকে ক্যামেরা দেয়নি। বেশির ভাগ স্টুডিও ছিল বন্ধ।
আমি শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের প্রথম ছবি তুলি ১৯৭৩ সালে চারুকলার বার্ষিক প্রদর্শনীতে। বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করতে। এখন যেটা জয়নুল গ্যালারি, সেখানে তার একক প্রদর্শনী হয়েছিল। সেই পেইন্টিংগুলোর কথা মনে পড়লে এখনো আমার গা ছমছম করে। ছবিগুলো ছিল মুক্তিযুদ্ধের, শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সেলফ পোর্ট্রেট। হাতে রাইফেল নিয়ে তিনি দৌড়াচ্ছেন, সঙ্গে অনেক মুক্তিযোদ্ধা। হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার ভিড়ের মধ্যে তিনি। সে পেইন্টিংগুলো যে কোথায়...কে নিয়ে গেল!
সেদিন শাহাবুদ্দিন ভাইসহ তার পোর্ট্রেটগুলোর সামনে আমি ছবি তুলেছিলাম। শাহাবুদ্দিন ভাই তার তুলির আঁচড়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়টা তুলে ধরেছেন।
আমি তার প্যারিসের বাসভবনে কয়েকবার গিয়েছি। প্রত্যেকবারই আমি তার স্টুডিওতে ঢুকে বঙ্গবন্ধুর পেইন্টিংগুলো বারবার দেখি। এরপর চলে যাই ডাইনিং টেবিলের কাছে, সেখানে বঙ্গবন্ধুর বিশাল একটি ছবি রয়েছে। যারা তার বাসায় যান, তাদের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা ওই ডাইনিং টেবিলের পাশের বিরাট জানালা, কারণ এখান থেকে দেখা যায় প্যারিস নগরী ও দূরে আইফেল টাওয়ার। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ছবির দিকে তাকিয়ে আমার বরং মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয় বঙ্গবন্ধু নিঃসঙ্গ, কেউ নেই তার সঙ্গে। শাহাবুদ্দিন ভাইকে এ কথা বললে তিনি বলেন, ‘মামুন তুমি খুব ভালো বিশ্লেষণ করেছ তো। আমি কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ওইভাবেই এঁকেছি, তিনি নিঃসঙ্গ একা।’
২০২০ সালে আমার তোলা বঙ্গবন্ধুর আলোকচিত্র নিয়ে ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে শাহাবুদ্দিন ভাই ঢাকায় আসেন। ওই উদ্বোধনীর স্মারক লেখায় শাহাবুদ্দিন ভাই লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। মামুন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফির উদ্বোধন করল বাংলাদেশে। আমাদের গৌরবময় দিনগুলোয় রাজনীতি, সাহিত্য, সংগীত বা শিল্পকলায় যারা অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন তাদের সকলের বিশেষ মুহূর্ত সে তার ক্যামেরায় ধরে রাখতে আরম্ভ করল। ওই কৈশোর বয়সে কেন সে তার সমসাময়িক অন্য সকল আলোকচিত্রী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক শিল্পভুবন রচনা করল ভেবে অবাক হই আমি। প্রকৃতিনির্ভর আলোকচিত্র ধারণে প্রায় সবাই যখন ক্যামেরা ফোকাস করছেন, মামুনের তীব্র দৃষ্টি তখন বিভিন্ন বিষয়ের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের মুখে। প্রকৃতি থেকে সরে এসে সে আলো ফেলল সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বে। বাংলাদেশের আলোকচিত্রের সাম্রাজ্যে এই বাঁক পরিবর্তন যেমন অভিনব তেমনি সাংস্কৃতিক ইতিহাসের আলোকে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।’
আমি বঙ্গবন্ধুর অনেক ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছি, শাহাবুদ্দিন ভাই আমাকে এ কারণে পছন্দ করেন। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। আমরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলাম। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে আমি তার সঙ্গে থেকেছি। গণমানুষের আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়, তখন টিএসসিতে তাকে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল, সেখানে তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়, সেখানেও শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমি ছিলাম।
আমার তোলা বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে শাহাবুদ্দিন ভাই বেশ কয়েকটি পেইন্টিং করেছেন। আমার কাছে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী। মুক্তিযুদ্ধের সময় চিত্রশিল্পীদের মধ্যে তার মতো এত সক্রিয় কেউ ছিলেন না।
শুভ জন্মদিন শাহাবুদ্দিন ভাই।
সৌজন্যে: দৈনিক বণিক বার্তা।
এবিএন/জনি/জসিম/জেডি
এই বিভাগের আরো সংবাদ