আজকের শিরোনাম :

বালুশ্রমিক গুলজারের ২৪০০ কবিতা

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:৩৯

প্রকাশিত নিজের তিনটি কাব্যগ্রন্থ হাতে গুলজার হোসেন
গুলজার হোসেনকে পরিচিত মানুষেরা ‘গরিব কবি’ নামে চেনেন। অর্থবিত্তে ‘গরিব’ তিনি, তবে তাঁর ঐশ্বর্য কবিতায়। পেশায় বালুশ্রমিক গুলজার দুই হাজারের বেশি কবিতা লিখেছেন। দুই শতাধিক গানের কথাও লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ। ঝিনাইদহের কবি গুলজার হোসেনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।

তুমি আরেকটু দুঃখ দাও তো
আরেকটু নির্যাতন করো তো
দেখি তাদের মতো হয় কিনা।
তাদের দেয়া দুঃখ নির্যাতনে
আমার হৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে যেত
ভাষা হারিয়ে যেত, দুপুর হতো ঘন অন্ধকার
আমি পাথুরে পাহাড় হয়ে যেতাম
ঝরনার সৌন্দর্য হয়ে উঠত বেদনার অশ্রু।

গুলজার হোসেনের ‘আরেকটু দুঃখ দাও তো’ কবিতার অংশবিশেষ এটি। নিজের দুঃখবোধ, আনন্দ-উচ্ছ্বাস আর পাওয়া না পাওয়ার কথা কবিতার নীতিমালায় গাঁথেন গুলজার হোসেন। অথচ কি শ্রমসাধ্য সকালই না শুরু হয় তাঁর! ভোর না হতেই বিছানা ছাড়েন। মুখে কিছু পুরে বেলচা হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন গন্তব্যে। তাঁর গন্তব্য ঝিনাইদহ শহরের ট্রাকস্ট্যান্ড। বালুভরা ট্রাকের সঙ্গে ছুটে যান বিভিন্ন এলাকায়। ট্রাক থেকে বালু নামানোই তাঁর পেশা, রোজগারের পথ। দুই হাতে বেলচা চালান।

বালু নামানোর শ্রমে যখন গা বেয়ে দরদর কর ঘাম ঝরে, তখনো তিনি ভাবেন কবিতার ছন্দ। বাড়ি ফিরেই মাথায় খেলে যাওয়া কোনো পঙ্‌ক্তি লিখতে বসেন। খাটুনির কষ্ট ভোলেন সদ্য ভূমিষ্ঠ কবিতায়। 

দিনে দিনে এভাবে দুই হাজারের বেশি কবিতা লিখেছেন গুলজার হোসেন। ঝিনাইদহ শহরের বালুশ্রমিক এই মানুষ নিজেকে ‘গরিব’ নামে পরিচিত করিয়েছেন। এখন ‘গরিব কবি’ নামেই অনেকে চেনেন। কবি হিসেবেও স্থানীয় মানুষজনের স্বীকৃতি পেয়েছেন। 

সম্প্রতি গুলজার হোসেনের কবিতা ‘তোমাকে হত্যার পর’ ভারতের আবৃত্তিকার অনিন্দিতা মোদক আবৃত্তি করেছেন, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ‘নদী মানুষ ও বাঁক’ নামে একটি প্রবন্ধ ভারতের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ঝিনাইদহের বেগবতি প্রকাশনা ল্যাম্পপোস্টই আলো, ঢাকার ইনভেলাপ প্রকাশনা থেকে গরিবের বিদ্বেষ ও কুহকে মোহিত নামে তাঁর তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

তবে গুলজার হোসেন বলেন, ‘আমি কবিতা লিখি আমার ভালো লাগার জন্য, নিজের জন্য। কবিতাই আমার ভাষা।’

শ্রমের ঘামে জীবন
গুলজার হোসেনের বাড়ি গিয়েছিলাম গত মাসে। ঝিনাইদহ শহরের কাঞ্চনপুর এলাকায় টিনের চালের দুই ঘরের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন।  ভাড়া বাড়ির এক অংশে চলে কাব্যচর্চা। বিভিন্ন লেখকের বই ঘরটাকে আলোকিত করেছে যেন। সেখানে বসেই কথায় তাঁর সঙ্গে।  

গুলজার হোসেনের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার মহারাজপুর গ্রামে। ১৯৮০ সালে অসচ্ছল এক পরিবারে তাঁর জন্ম। গ্রামের মহারাজপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। ১০ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে নেমে পড়েন। গুলজার বলেন, ‘আমার দরিদ্র বাবা পাঁচ ছেলেমেয়ের সংসার চালাতে খুব কষ্ট করতেন। ঠিকমতো আমাদের খাবার জুটত না। এ কারণে পড়াশোনা করতে পারিনি।’

আরেকটু বড় হলে গ্রাম থেকে আসতেন ৯ কিলোমিটার দূরের ঝিনাইদহ শহরে। আইসক্রিম বিক্রির পেশা বেছে নেন। মাথায় বাক্স নিয়ে ফেরি করতেন আইসক্রিম। যখন আইসক্রিম চলত না, তখন আবার চালিয়েছেন ভ্যান। এভাবেই ৯ বছর পার করেছেন। এর মধ্যে বিয়ে করেন সেলিনা বেগমকে। পরিবার নিয়ে ঝিনাইদহ শহরে চলে আসেন। তখন চালাতেন রিকশা।

গুলজার হোসেন বলেন, ‘২০০৫ সালে বেলচা হাতে তুলে নিই। ট্রাক থেকে বালু নামানোর কাজ শুরু করি। সেই সময়ে এক ট্রাক বালু নামালে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পেতাম, এখন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়।’

নিজে স্কুলে যেতে পারেননি। তবে দুই সন্তানকে পড়াচ্ছেন তিনি। গুলজারের মেয়ে মিতা নূর এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। ছেলে একরামুল কবির নবম শ্রেণিতে পড়ছে।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালিয়ে যেতে না পারলেও পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ তাঁর যথেষ্ট। মাঠের কাজ, আইসক্রিমের হকারি, ভ্যান চালানো—যখন যা করেছেন, তার মধ্যে সুযোগ করে বই পড়েছেন। নিজে বই কিনতে পারেননি, অন্যের কাছ থেকে ধার করে পড়তেন। সন্ধ্যা হলেই বিষয়খালী বাজারে বসে পত্রিকা পড়তেন। গুলজার বলেন, ‘অভাবের কারণে পড়তে পারিনি, তবে অজ্ঞ থাকব না এটা পণ করেছিলাম। তাই জ্ঞানার্জনের জন্য পড়ালেখা করতাম।’

সিগারেটের কাগজে কবিতা
বই পড়তে পড়তেই কবিতার অঙ্গনে প্রবেশ তাঁর। ২০০১ সালের কোনো একটা সময় তাঁর ইচ্ছা হয় কবিতা লেখার। কিন্তু কিসে লিখবেন। তখনকার রিকশাচালক গুলজারের বাড়িতে কাগজ ছিল না। কাগজ কেনার মতো বাড়তি টাকাও ছিল না। তাই বাজার থেকে সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে আনতেন। বাড়িতে বসে সেটায় লিখে ফেলেন ‘আহ্বান’ নামের একটি কবিতা। 

গুলজার বলেন, ‘প্রথম লেখা কবিতাটি দেখানোর পর সবাই খুব ভালো বলেছিল। সেখান থেকে উৎসাহ পেয়ে চালিয়ে যেতে থাকি কবিতা লেখা।’ একে একে ‘এখানে যা নেই’, ‘তোমাকে হত্যার পর’, ‘গরিবের বিদ্বেষ’, ‘প্রিয় সাবির হাকা’, ‘উত্তপ্ত পৃথিবী’, ‘গভীর রাত’, ‘ভাইরাস’সহ প্রায় ২ হাজার ৪০০ কবিতা লিখেছেন। শুধু কি কবিতা? গান লিখেছেন ২১০টি, যেগুলো স্থানীয় অনেক শিল্পীর কণ্ঠে শুনছেন শ্রোতারা। ১০টি প্রবন্ধও লিখেছেন তিনি। 

গুলজার হোসেন বলেন, ‘আগে ভ্যান-রিকশা চালানোর সময় কবিতা মনে আসত। আর বালুশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করার পর প্রতিদিন ভোর হলেই বেলচা কাঁধে নিয়ে ট্রাকে চলে যেতাম। বালু বিক্রির পর ক্রেতার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসতাম। এ সময় কবিতার ছন্দ মাথায় খেলত। বাড়িতে ফিরে গিয়ে লিখতে বসে যেতাম।’

যখন যে কাজই গুলজার হোসেন করেছেন, কবিতা-গান থাকত তাঁর মনের ভেতর।

ফেসবুক আনল পরিচিতি
অনেকটা সময় গুলজার হোসেনের লেখাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। তিনি নিজে লিখতেন, পছন্দের কাউকে পড়াতেন। তবে সব লেখা জমিয়ে রেখেছেন। প্রায় ছয় বছর আগে ফেসবুকে কিছু কবিতা পোস্ট করেন। একসময় পাঠকের সাড়া পান। মানুষ তাঁর কবিতা আবৃত্তি করে। প্রকাশিতও হয় বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকায়। দেশের দুটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর কাব্য প্রতিভা দেখে ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম একটি কম্পিউটার উপহার দিয়েছেন। নিজের চেষ্টায় তিনি কম্পিউটারে লেখার দক্ষতা অর্জন করেছেন। এখন সেই কম্পিউটারে লিখছেন এই কবি।

কবিতায় শ্রমিক শ্রেণির বঞ্চনা
গুলজার হোসেনের কবিতা নিয়ে ঝিনাইদহের কবি ও গবেষক সুমন সিকদার বলছিলেন, ‘গুলজার প্রচুর পড়াশোনা করেন। তাঁর কবিতা মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। এভাবে চর্চা করলে আরও বেশি ভালো করতে পারবেন।’

ঝিনাইদহ সরকারি কেশব চন্দ্র (কেসি) কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হাসান অরিন্দম বলছিলেন গুলজার হোসেনের কবিতার নানা দিক নিয়ে। তাঁর মতে, ‘অত্যন্ত সংগ্রামী একজন মানুষ তিনি। তাঁর কবিতায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও শ্রমিক শ্রেণির বঞ্চনার কথা থাকে। একসময় পুরোনো ধাঁচের কবিতা লিখলেও স্বশিক্ষিত এই কবি এখন আধুনিক কবিতা লিখছেন।’

 

সৌজন্যে: দৈনিক প্রথম আলো

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ