পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবস আজ

  অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২১, ০৯:৩৫

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান দিকপাল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক, লেখক ও জনহিতৈষী এই মহান ব্যক্তিত্ব ১৮২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদেনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামের দারিদ্র্যপীড়িত এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই তিনি মারা যান।

গ্রাম্য পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা শেষে পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় চরম অর্থকষ্টেও তাঁকে কলকাতায় পড়তে পাঠান। সেখানে তিনি ১৮২৯ থেকে ১৮৪১ সাল পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। অসাধারণ প্রতিভার কারণে কলেজের সব পুরস্কার ও বৃত্তি ছিলো তাঁর করায়ত্ত। কাব্য, অলঙ্কারশাস্ত্র, বেদান্ত, স্মৃতি, জ্যোতিষ ও যুক্তিবিদ্যায় তাঁর কৃতিত্বের জন্য ১৮৩৯ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সম্মানসূচক ‘‘বিদ্যাসাগর’’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র ২১ বছর বয়সে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রধান পন্ডিত হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৮৫০ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরের বছর অধ্যক্ষ পদে উন্নীত হন। কলেজে অধ্যক্ষের দ্বায়িত্ব পালন কালীন ১৮৫৫ সালে সরকার তাঁকে হুগলি, বর্ধমান, মেদেনীপুর ও নদীয়া জেলার বিশেষ স্কুল পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব অপর্ণ করেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি (কলকাতা) ও বেথুন সোসাইটিসহ আরও কিছু সংগঠনের সম্মানিত সভ্য ছিলেন। ১৮৫৮ সালে যাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো নির্বাচিত হন তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম।

বাংলা গদ্যরীতির সংস্কারক বিদ্যাসাগর লেখক হিসেবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রাচ্যবিদদের অনুসৃত নতুন কিন্তু কৃত্রিম ছন্দোরীতি, রামমোহন, ও তাঁর অনুসারীদের পন্ডিতি মনোভাবসুলভ ও সংস্কারবিরোধী ধারা এবং সমসাময়িক সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলির অমার্জিত ভাষাকাঠামো সজ্ঞানে পরিহার করেন। তিনি স্বকীয়ভাবে এক নতুন রীতির প্রবর্তন করেন যা আধুনিক বাংলা গদ্যের ভিত রচনা করে।

যেহেতু বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি তাঁর পাঠ্যপুস্তকে প্রকাশ পেয়েছে এবং বিশ শতকের প্রথম কয়েক বছর পর্যন্ত তাঁর রচিত গ্রন্থই সাধারণভাবে সকল সরকারি ও স্বদেশীয় বিদ্যালয়সমূহে চালু ছিল, সেহেতু কয়েক প্রজন্মের লেখক, আমলা ও পেশাজীবীগণ প্রত্যক্ষ ও স্থায়িভাবে তাঁর গদ্যরীতি দ্বারা প্রভাবিত হন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অতীত ও বর্তমান কৌশলের সংশ্লেষণই ছিল তাঁর রীতির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি ইম্পেরিয়াল অ্যাসেমব্লিজ-এ সম্মাননা-সনদ লাভ করেন এবং ১৮৮০ সালের জানুয়ারিতে সি.আই.ই হন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেন।

বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁর সমসাময়িক লেখকদের তুলনায় ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। তাঁর লেখা সৃষ্টিশীল ছিল না বরং শিক্ষা, সংস্কারমূলক এবং উপযোগবাদী ছিল। মহাভারত উপক্রমণিকা এবং বেতালপঞ্চবিংশতি সহ (১৮৪৭) প্রথমদিকের রচনাসমূহ ছিল অনুবাদকর্ম।

প্রকৃতপক্ষে তাঁর মোট ৩২টি রচনার অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজী গন্থের অনুবাদ এবং এগুলো ছিল স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্য বিষয়। তাঁর একমাত্র পান্ডিত্যপূর্ণ মৌলিক রচনা হলো সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৩) যা সাধারণের নিকট অজ্ঞাত থেকে থেকে যায়।

তবে পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা হলেও বিদ্যাসাগর তাঁর সমসাময়িক প্রতিষ্ঠিত লেখকদের কাছে একজন সুরুচিসম্পন্ন লেখক ও অনুপ্রেরণাদানকারী শিক্ষাব্রতী হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। তাঁর হাতেই বাংলা গদ্য এক নতুন রূপ লাভ করে। সমালোচকদের মতে বিদ্যাসাগর-ই বাংলা গদ্য সাহিত্যে নবযুগের সৃষ্টি করেন।

বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন সংস্কারক ও চিন্তাবিদ। বাঙ্গালার ইতিহাস (২য় খন্ড,১৮৪৮) নামক গ্রন্থে মার্শম্যান তত্বের বিপরীতে তিনি বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশেস ক্ষেত্রে সমন্বয়বাদী এবং সংশ্লেষণবাদী ধারা নিখুঁতভাবে প্রদর্শন করেন। ব্যক্তিগত ভাবে গোঁড়া হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন ধর্মের পন্ডিতদের মতাতম এবং পরামর্শ সাদরে গ্রহণ করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্কারমনা দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সমাজ-ধর্মীয় চিন্তা-চেতনায় দৃঢ় ভাবে প্রকাশ পায়। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ এবং সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহতকারী অন্যান্য অশুভ তৎপরতা সম্পর্কে তিনি যুক্তি উত্থাপন করেন।

তাঁর অধিকাংশ সংস্কার মূলক চিন্তা-ভাবনা ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিৎ কি না’ এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব দুই খন্ড (১৮৫৫) এবং ‘বহু বিবাহ রহিত হওয়া উচিৎ কি না’ এতদ্বিষয়ক বিচার দুই খন্ড (১৮৭১) নামক বিখ্যাত দুটি গ্রন্থে প্রতিফলিত হয়েছে। বহুবিবাহ, বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি বিষয় তৎকালীন সময়ে ধর্মীয়ভাবে খুব স্পর্শকাতর ছিল।

বিদ্যাসাগর সমাজের এই দুষ্ট ক্ষত সমূহ সরাসরি আক্রমনের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিবে আঘাত হানতে চাননি। কৌশল হিসেবে তিনি তাঁর যুক্তির স্বপক্ষে বিভিন্ন শাস্ত্র ও প্রাচীন গ্রন্থ থেকে অসংখ্য উদাহরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে জনসাধারণের ওপর গভীর প্রভাব সৃষ্টি করেন।

তাঁর শাস্ত্র বচন ও বিদ্রূপাত্মক যুক্তি উক্ত সামাজিক প্রতিবন্ধকতার রক্ষকদের ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ করেছিল, যদিও তিনি অনেক রক্ষণশীল কর্তৃক মারাত্নকভাবে নিন্দিতও হয়েছিলেন। বিধবাবিবাহ বৈধ করণে ১৮৫৬ সালের আইনের কার্যকারিতায় এবং দ্বি-বিবাহ ও বাল্যবিবাহ রহিতকরণ ও বিধবাবিবাহ উৎসাহ প্রদানে ১৮৭২ সালের সিভিল ম্যারেজ এ্যাক্ট-এ বিদ্যাসাগরের প্রভূত অবদান রয়েছে। তাঁর লেখা ও কার্যাবলি উক্ত বিষয়াবলির স্বপক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক সহায়তা করে। এসব কারণে বিদ্যাসাগর বাংলার নবজাগরণের এক শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে বিবেচিত হন।

বিশেষ বিদ্যালয় পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর তাঁর ক্ষমতার স্বদব্যবহার করেন ভূস্বামী ও অন্যান্য স্বচ্ছল ব্যক্তিদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে উৎসাহিত করার জন্য। তিনি তাঁর পরিদর্শন এলাকায় বালিকা বিদ্যালয়সহ অসংখ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। কিছু বিদ্যালয় তাঁর স্বীয় উদ্যোগ ও আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন তাঁর এক মহৎ র্কীতি। তিনি এটি নিজ অর্থব্যয়ে ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠা করেন। এটি একটি আদর্শ কলেজ এবং এর সঙ্গে একটি স্কুলও আছে। বিদ্যাসাগরের মানবপ্রেম ছিল প্রবাদতুল্য। কথিত হয় যে, তাঁর বেতন এবং রয়ালটি বাবদ প্রাপ্ত অর্থের অর্ধাংশ দুঃখ-পীড়িতদের সাহায্যের জন্য সংরক্ষিত থাকত। বিদ্যাসাগর তাঁর বহুমুখি প্রতিভার দ্বারা সমাজ-সংস্কারসহ শিক্ষাক্ষেত্রে অতুলনীয় অবদান রেখে গেছেন।

শিক্ষাবিদ, সংস্কারক, লেখক ও মানবতাবাদী হিসেবে তিনি এতো বড় মাপের একজন ব্যক্তি ছিলেন যে, ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই তাঁর মৃত্যুতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ শোকাভিভূত হয়ে পড়েছিল। সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহে শোক সংবাদ এবং তাঁর কর্মের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিভিন্ন কবি ও লেখক বিদ্যাসাগরের স্মরণে কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। এভাবে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা অর্জনের ফলে বিদ্যাসাগর সে শতকের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হন।

এবিএন/শংকর রায়/জসিম/পিংকি

এই বিভাগের আরো সংবাদ