আজকের শিরোনাম :

‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ ও কয়েকটি সামান্য কথা

  সৌভিক রেজা

২৫ জুলাই ২০২১, ১০:৫৮ | অনলাইন সংস্করণ

বুয়েনস আইরেসে ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া
১.

শঙ্খ ঘোষের ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রাবণ ১৩৮০ বঙ্গাব্দে, খ্রিস্টাব্দের হিসেবে আগস্ট, ১৯৭৩ সালে। বইটির ‘স্বীকৃতি’ অংশে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন—

“হঠাৎ একদিন ছোটো একখানি বই হাতে এল আয়ওয়ার লাইব্রেরিতে। স্পেনীয় ভাষায় লেখা। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে লিখেছেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো।

বই? এর আগে তাঁর লেখা দুটি-একটি স্মৃতিপ্রবন্ধ পড়েছি বটে ইংরেজিতে; কিন্তু পুরো একখানি বই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে? এর কি কোনো ইংরেজি অনুবাদ আছে? বাংলা?”

এরপরই শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছেন, “দেশের কোনো কোনো রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞকে চিঠি লিখে জানলুম যে তাঁরা জানেন না বইটির খবর, আর ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো জানালেন যে বইটির সম্পূর্ণ কোনো ইংরেজি অনুবাদ হয়নি এখনো।”

২.

শঙ্খ ঘোষের অনুবাদটি ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল সুনীলকুমার নন্দীর ‘অনুক্ত’ পত্রিকায়। এরপর বইটির পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর, ১৯৭৬ সালে। পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত তৃতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সালে। পরিমার্জিত চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয় জানুয়ারি ১৯৮৯ সালে। পঞ্চম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ভাদ্র, ১৪০২ অর্থাৎ আগস্ট ১৯৯৫ সালে।

৩.

এই পাঁচটি সংস্করণের ‘ভূমিকা’য় বিভিন্ন বইয়ের, নানান মানুষের নাম এসেছে কিন্তু অবাক লাগে একবারও প্রেমেন্দ্র মিত্রের নাম শঙ্খ ঘোষ উচ্চারণ করেননি।

৪.

প্রশ্ন উঠবে, এখানে প্রেমেন্দ্র মিত্রের কথা কেন উঠছে? উঠছে, তার কারণ হচ্ছে, শঙ্খ ঘোষ খোঁজ নিয়েছিলেন ওকাম্পোর বইয়ের কোনো বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল কিনা। যাঁদেরকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁরা তাঁকে এই বিষয়ে কিছুই জানাতে পারেননি। কিন্তু সম্প্রতি অবাক হয়ে দেখতে পেলাম ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার কার্তিক-পৌষ, ১৩৬৮ সংখ্যায় অর্থাৎ ১৯৬১ সালে, যখন রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে, তখন ওকাম্পোর স্মৃতিকথার অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। আর সেটি অনুবাদ করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র।

৫.

শঙ্খ ঘোষের অনুবাদের শিরোনাম— ‘সান ইসিদ্রোর শিখরে রবীন্দ্রনাথ’। অন্যদিকে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনুবাদের শিরোনাম— ‘প্লেট নদীর তীরে’।

শঙ্খ ঘোষের অনুবাদ শুরু হচ্ছে এইভাবে—

“১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বরে শোনা গেল, বুয়েনস আইরেস থেকে লিমা যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর নিজের ইংরেজি থেকে অথবা জিদের ফরাসি অনুবাদ থেকে আমরা যারা জানতাম তাঁর রচনা, আমাদের তখন শুরু হলো প্রতীক্ষা! এখানে তাঁর আবির্ভাব সে বছরের সব-সেরা ব্যাপার। আর আমার পক্ষে তো এটা জীবনেরই সবচেয়ে বড়ো ঘটনা।”

অন্যদিকে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনুবাদে দেখি—

“১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শুনলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুয়োনেস এয়ার্স হয়ে পেরু যাবেন। সেই থেকে কবির জন্যে কী অধীর আমাদের প্রতীক্ষা। আমরা যারা জিদ-এর ফরাসি অনুবাদে, ইয়েটস-এর ভূমিকা-সংবলিত তাঁর নিজের অনুবাদে ও জুয়ান র‌্যামন জিমেনেজ-এর স্ত্রী জেনোবিয়া ক্যামপ্রুবি-র স্প্যানিশ ভাষার অনুবাদে তাঁর কবিতা পড়েছি তাদের কাছে সে বৎসরের সেটা একটা মস্ত বড় ব্যাপার। আমার জীবনে তো সেটি মহত্তম ঘটনাবলীর একটি।”

৬.

শঙ্খ ঘোষের অনুবাদ সমাপ্ত হচ্ছে এই বাক্য দিয়ে— ‍“একটিই শুধু ইতিহাস আছে, আত্মার ইতিহাস।” অন্যদিকে, প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনুবাদে পাচ্ছি— “আত্মার ছাড়া আর কিছুর ইতিহাস নেই। ইতিহাস মানে শুধু আত্মারই ইতিহাস।”

৭.

এখন প্রশ্ন জাগে, ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই দীর্ঘ অনুবাদ শঙ্খ ঘোষ ও তাঁর পরিচিত রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি কীভাবে এড়িয়ে গেলো?

৮.

শুধুই শঙ্খ ঘোষ নন, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে যিনি বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই গবেষণা করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন, সেই কেতকী কুশারী ডাইসনও যে প্রেমেন্দ্র মিত্রের অনুবাদের খবর জানতেন না, সেটি তাঁর লেখা থেকে স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, “কবি শঙ্খ ঘোষ যখন ভিকতোরিয়ার রবীন্দ্রবিষয়ক পুস্তিকাটি বাংলায় অনুবাদ করে আমাদের উপহার দেন তখন ভূমিকা ও অনুষঙ্গে ভিকতোরিয়ার বৃহত্তর ব্যক্তিত্বের একটা আভাস দেবার প্রশংসনীয় চেষ্টা করেছিলেন তিনি।” ( ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিকতোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’, দে’জ সংস্করণ : জানুয়ারি, ১৯৯৭, পৃ. ২০) এখানে প্রেমেন্দ্র মিত্রের নাম উচ্চারণের সুযোগ ছিলো কিন্তু কেতকী কুশারী যখন ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার অনুবাদটি সম্পর্কে কোনো তথ্য জানেন-ই না, তখন প্রেমেন্দ্র মিত্রের নাম কীভাবে উচ্চারণ করবেন। এইভাবেই ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে চর্চার জগতে শঙ্খ ঘোষ-কেতকী কুশারী ডাইসনের যুগ্ম বৃত্ত থেকে ছিটকে পড়ে যান প্রেমেন্দ্র মিত্র!

৯.

ভিক্টোরিয়ার রবীন্দ্র-স্মৃতিকথার প্রথম অনুবাদক প্রেমেন্দ্র মিত্র মৃত্যুবরণ করেন ১৯৮৮ সালের ৩ মে। এর মধ্যে শঙ্খ ঘোষের অনুবাদের তিন-তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও এই বিষয়ে কেউ তাঁকে কখনও কিছু জানাননি? কেতকীর বইটিরও প্রথম প্রকাশ এপ্রিল, ১৯৮৫ সালে। তখনও প্রেমেন্দ্র মিত্র জীবিত।

আবার, প্রেমেন্দ্র মিত্রও নিজে থেকে বা কারোর মাধ্যমে শঙ্খ ঘোষকে কিংবা কেতকী কুশারী ডাইসনকে তাঁর ভিক্টোরিয়ার রবীন্দ্র-অনুবাদের কথা কেন জানাননি বা জানাতে চাননি— সে-ও এক রহস্য বটে! এই অনুবাদটি নিয়ে কি তাঁর নিজের মধ্যে কোনো ধরনের সঙ্কোচ ছিলো?

৮.

প্রেমেন্দ্র মিত্র-শঙ্খ ঘোষ-কেতকী কুশারী ডাইসন— এঁদের পারস্পরিক সম্পর্কের ইতিবৃত্ত আমাদের অন্তত জানা নেই। কলকাতার বন্ধুরা এই বিষয়ে কিছু জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো!

লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

সৌজন্যে: দৈনিক দেশ রূপান্তর

এবিএন/জনি/জসিম/জেডি

এই বিভাগের আরো সংবাদ